আইফোন ৭ লঞ্চ হল কদিন আগে। নতুন ফিচারস আদৌ কিছু এল কিনা সেটা তর্ক সাপেক্ষ। উপরন্তু একটু মোবাইল নিয়ে নাড়াঘাটা করা লোকজন মাত্রেই মানবেন আইফোনের অর্ধেকেরও কম দামে অ্যান্ড্রয়েডের অনেক ফোন রয়েছে একই বা আরো ভাল স্পেসিফিকেশনে। আসলে কোল্ডপ্লে কনসার্ট, আকাশ ছোঁয়া দাম আর চতুর ব্র্যান্ডিং দ্বারা এই ফোনকে ঘিরে বহুবছর ধরেই একটা এক্সক্লুসিভিটির মোহজাল তৈরী করা হয়েছে। কোম্পানির ক্যাচলাইন সেই জন্যই "ইফ ইউ ডোন্ট হ্যাভ অ্যান আইফোন, ইউ ডোন্ট হ্যাভ অ্যান আইফোন"! আমি সিওর আইফোনের ওই জ্বলজ্বলে আপেলের লোগো বাদ দিয়ে কাল যদি একই স্পেসিফিকেশনের একটা ফোন আনে অ্যাপল, বেশিরভাগ গ্রাহক সেটা কিনবেন না, দাম আদ্ধেক করে দিলেও না। তবুও হুজুগে ক্রেতার আদেখলামো শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই গোটা বিশ্বজুড়ে, বিশেষত আমেরিকায়।
যাইহোক আইফোন কতটা ওভাররেটেড বা এর প্রযুক্তিগত দিক নিয়ে আলোচনা করার জন্য এই পোস্টের অবতারণা করিনি। বরং এক একট ঝকঝকে স্লিম আইফোনের পিছনে কতটা কালো দাগ লেগে থাকে সেই ব্যাপারেই দুকথা বলার ছিল। আশা করি অনেকেই জানেন যে আইফোনের ডিজাইন আমেরিকান হলেও ফোন বানানো অর্থাৎ অ্যাসেম্বলিং এর কাজ হয় চিনেই। সেটা অস্বাভাবিক না, কারণ বেশিরভাগ বড় কোম্পানির ফোনই আজকান মেড ইন চায়না। কিন্তু কেন? সেটা ভেবে দেখেছেন? আসুন সেটাই নাহয় একটু বিশদে দেখা যাক।
চিনে আইফোন অ্যাসেম্বল করার মোটামুটি তিনটে বড় কোম্পানি আছে যারা ঠিকাচুক্তি ভিত্তিতে অ্যাপলের সাথে কাজ করে। ফক্সকন, পেগাট্রন এবং উইসট্রন। এর মধ্যে সবথেকে বড় এবং বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত?) কোম্পানি হল ফক্সকন। ফক্সকন আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলে দেয় ২০১০ সালে যখন কারখানার ১৮ জন শ্রমিক আত্মহত্যার চেষ্টা করে। হ্যাঁ তাদের মধ্যে ১৪ জন সফলও হয়। যাইহোক এরপর অবশ্যই ফক্সকন দ্রুত ব্যবস্থা নেয় এরকম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি আটকাতে। কি ব্যবস্থা? উমম.. কারখানার চারদিকে বড়বড় জাল লাগানো হয় যাতে আর কেউ ঝাঁপ না দিতে পারে..!! ও হ্যাঁ, সেইবছরই ফক্সকনের লোংঘুয়া ফ্যাক্টরিতে দিনে গড়ে ১৩৭০০০ আইফোন বানানো হয়। মানে মিনিটে ৯০টা! সেই ১৮জন শ্রমিকের মধ্যে ছিল ১৭ বছরের কিশোরী টি-আন ইউ, যে ৪ তলার ডর্মিটরি থেকে ঝাঁপ দিয়েও (দুর্ভাগ্যক্রমে?) বেঁচে যায় এবং কোমরের নীচ থেকে প্যারালাইজড হয়ে পড়ে। তার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি শ্রমিককে সপ্তাহে ৬ দিন নামমাত্র মজুরীতে দিনে ১২ ঘন্টা খাটতে হত। দিন এবং রাত্রি উভয় শিফটেই। আর সাথে বরাদ্দ ছিল একটি ঘুপচি ডর্মিটরি ঘর ৮জন গাদাগাদি করে থাকার জন্য! এসব ঘটনা প্রকাশে আসার পর অবশ্য অ্যাপল একটু নড়েচড়ে বসে। চাইনিজ শ্রমিকদের ভাল থাকার প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি প্রভৃতি সমেত ঝলমলে পুস্তিকা ছাপানো হয়। অ্যাপলের বিভিন্ন ইভেন্টে বিলিও করা হয়। ব্যাস। এই অবদিই। কারণ আগের বছরই চায়না লেবার ওয়াচ নামের আমেরিকান এনজিও-এর করা রিসার্চে দেখা যায় কিভাবে শ্রমিকদের উপর অমানুষিক শোষণ এখনো অব্যাহত রয়েছে। আইফোনের আরেক অ্যাসেম্বলার পেগাট্রনের উপর করা গোপন রিসার্চে উঠে এসেছে অকল্পনীয় সব তথ্য। পেগাট্রনে একজন চাইনিজ শ্রমিক সপ্তাহে ৬দিন, দিনে ১২ ঘন্টা কাজ করেন - যার মধ্যে দৈনিক ১.৫ ঘন্টা আবার আনপেইড লেবার! প্রতি শ্রমিক দিনের পুরো সময় দাঁড়িয়ে কাজ করেন! এবং প্রতি ৩.৭৫ সেকেন্ডে একটা আইফোনে মাদার বোর্ডের কাজ শেষ করতে হয়! গত বছর সাংঘাইতে নূন্যতম শ্রমিক মজুরি বাড়ানো হয়েছিল। তাই পেগাট্রন কতৃপক্ষ শ্রমিকের চিকিৎসা বিমার টাকা ছেঁটে ব্যাপারটা ব্যালান্স করে দেন। নিখুঁত কি বলেন? উইসট্রন নামের অন্য কন্ট্রাকটরের উপর ড্যানিশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ড্যানওয়াচের রিপোর্টে জানা যায় তারা ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার করে কম খরচে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। স্থানীয় স্কুল এবং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের বাধ্যতামূলক ভাবে মাসের পর মাস কারখানায় একজন সাধারণ শ্রমিকের মতই হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়, কিন্তু অনেক কম পারিশ্রমিকে। ড্যানওয়াচকে এক ১৯ বছরের ছাত্রী জানান, এই কারখানায় কাজে স্বেচ্ছায় রাজী নাহলে কলেজ থেকে ডিগ্রী না দেবার হুমকিও দেওয়া হয়!
তাহলে ব্যাপারটা যা দাঁড়াল শ্রমিকদের ঘন্টা প্রতি মাত্র ১.৬ ডলার দিয়ে আমাদের ৭০০০০ টাকায় ফোন বেচে অ্যাপল মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলছে। শুধু গতবছরেই তাদের লাভ ছিল ৪৭ বিলিয়ন ডলার। মোট সম্পদের দিক থেকে (২৩১ বিলিয়ন ডলার) অ্যাপল আমেরিকার সরকারের থেকেও ধনী! তবুও তারা শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরিটুকু দিতে নারাজ। শ্রমিকদের শোষণ করা আর ক্রেতাদের টুপি পরানো - এই মোটামুটি অ্যাপলের বিজনেস মডেল! এবার আপনি ভেবে দেখুন। পরেরবার সদ্য কেনা আইফোনে সেল্ফি তোলার সময় ১৭ বছরের কিশোরীর ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়া স্ক্রিনে ভেসে উঠবে না তো? কিংবা আইপ্যাড বা আইপডে গান শোনার সময় কানে ১২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ শ্রমিকের হাঁপানির শব্দ কানে আসবে না তো? টাকা আপনার। আপনি সেটা অ্যাপলের গগনচুম্বী মুনাফার পাহাড়ে যোগ করে সেই পাহাড়ের তলায় লাখ লাখ শ্রমিককে পিষে মারবেন কিনা সেই সিদ্ধান্তও আপনার। একেবারেই আপনার।
ঋণস্বীকার : দ্যা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত আদিত্য চক্রবর্তীর প্রবন্ধ।