কিছু সংবাদমাধ্যম রাজ্যের মানুষকে বিরোধীদের জোটের কথা বলে যতই বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করুক, রাজ্যের মানুষ জানেন কিসে তাঁদের ভালো, আর কিসে তাঁদের খারাপ হয়। তাই মানুষ এবারেও বামফ্রন্টের পাশেই থাকবেন, বামফ্রন্টকেই জয়ী করবেন। পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘গণশক্তি’-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান ও সি পি আই (এম)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক বিমান বসু। সিঙ্গুর থেকে বিরোধীদের গাড়ি কারখানা তাড়ানো থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তৃতীয় শক্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা, নানা বিষয়েই তিনি তাঁর রাজনৈতিক মতামত দিয়েছেন এই সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রসূন ভট্টাচার্য।
প্রশ্ন: পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনের আগে দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের জোট ইউ পি এ টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ইউ পি এ-র শরিকরা আলাদা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় শক্তির সম্ভাবনা কতটা? তারা কি আদৌ কেন্দ্রে সরকার গড়তে পারবে?
বিমান বসু: এবারের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউ পি এ এবং বি জে পি—র নেতৃত্বাধীন এন ডি এ উভয়েই ভারতের জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হবে। ইতোমধ্যেই ইউ পি এ এবং এন ডি এ —র শরিকদের অনেকে ঐ জোটগুলি থেকে সরে এসেছে। এই দলগুলির মধ্যে যারা কংগ্রেস এবং বি জে পি কাউকেই সমর্থন করে না, তারা উপলব্ধি করছে ভিন্ন কোনো কর্মসূচী প্রয়োজন। ফলে বামপন্থীরা যে ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পের আহবান জানিয়ে ধীরে ধীরে তৃতীয় বিকল্প গড়ে তুলছে তাতে এই দলগুলির অনেকে যুক্ত হচ্ছে। সম্ভবত আরো অনেকে যুক্ত হবে নির্বাচনের পরে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে নির্বাচনের আগেই একটা ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পের কাঠামো গড়ে উঠতে শুরু করেছে। নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে এতে আরো অনেকে আসবে। আজ যারা তৃতীয় বিকল্প সম্পর্কে হেয় করা মন্তব্য করছে বা তৃতীয় ফ্রন্টের ভূমিকাকে গুরুত্বহীন বলে দেখানোর চেষ্টা করছে তারাও তখন বুঝতে পারবে কোনটা বাস্তব আর কোনটা অবাস্তব।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গত লোকসভা নির্বাচনের পর আমরা কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউ পি এ সরকারকে সমর্থন করেছিলাম কেন্দ্রে সাম্প্রদায়িক শক্তি বি জে পি-কে ক্ষমতায় ফিরে আসা ঠেকাতে। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রে সাম্প্রদায়িক এন ডি এ জোটের বদলে একটা ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠনের স্লোগান আমরা দিয়েছিলাম। সেই রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই আমরা এই সমর্থন করেছিলাম। কিন্তু আমাদের এই সমর্থন নিঃশর্ত ছিল না। সাধারণ ন্যুনতম কর্মসূচী রূপায়ণের শর্তেই বামপন্থীরা ইউ পি এ সরকারকে সমর্থন করেছিল। ইউ পি এ সরকার সেই কর্মসূচী রূপায়ণে অনীহা দেখিয়েছে। যেটুকু হয়েছে তা বামপন্থীদের ধারাবাহিক চাপের ফলেই। শুধু তাই নয়, ওরা সাধারণ মানুষের স্বার্থের এই কর্মসূচী রূপায়ণে বিরত থেকে জনস্বার্থবিরোধী নীতি নিয়ে চলেছে। দেশের স্বাধীন বিদেশনীতি বিসর্জন দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী পররাষ্ট্রনীতি নিচ্ছে। সেকারণেই এখন দেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ তৃতীয় বিকল্পের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, যারা স্বাধীন বিদেশ নীতি নিয়ে চলবে, দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে নীতি নেবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ ক্রমশ সেটা উপলব্ধি করছেন।
প্রশ্ন: বামপন্থীরা এই তৃতীয় শক্তিকে সংহত করতে বিভিন্ন অকংগ্রেসী এবং অ-বি জে পি দলের সঙ্গে আলোচনা করে একত্রিত করার চেষ্টা করছে। এই সংহতকরণ কতটা নীতির ভিত্তিতে হচ্ছে? তৃতীয় শক্তির মঞ্চে আসা এই দলগুলিকে কতটা বিশ্বাস করা যায়?
বিমান বসু: বিভিন্ন আঞ্চলিক দল তাদের কাজ নিজস্ব আঞ্চলিক ঘরানায় করে থাকে। কিন্তু আমরা বামপন্থীরা চেষ্টা করছি দেশের মানুষের ঐক্য ও সংহতির প্রশ্নে একযোগে কাজ করতে একটি সাধারণ ন্যুনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে পথ চলার উদ্যোগ নিতে। সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে এভাবে পথ চলার চেষ্টা করলে, ভিন্ন ভিন্ন পার্টি হলেও একই নীতির দ্বারা পরিচালিত হলে তখন বিষয়টিকে আদৌ নীতিহীন বলে মনে হবে না। আঞ্চলিক দলগুলির নেতৃত্বের কারো কারো মনে যাই থাক না কেন, তারা যদি সর্বভারতীয় ভিত্তিতে ভারতীয় জনগণের স্বার্থবাহী কর্মসূচী রূপায়ণ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচী গ্রহণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে তাদের দুর্বলতা থাকলেও তারা নিজেদের কাজের মধ্য দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারবে। কেউ বিশ্বাসযোগ্য কিনা, এটা কাজের নিরিখ ছাড়া বিচার করা খুবই কঠিন।
সব থেকে বড়ো কথা কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করার কর্মসূচী নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারলে তাতেও আঞ্চলিক দলগুলির গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। এই কাজের মধ্যে দিয়ে সর্বভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে।
প্রশ্ন: নির্বাচনের পরে তৃতীয় শক্তি সরকার গড়ার মতো অবস্থায় এলে সি পি আই (এম) কি তাতে যোগ দেবে?
বিমান বসু: নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে তৃতীয় শক্তির বর্তমান অবস্থার কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে। ভারতীয় জনগণের স্বার্থে সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচী তৈরি করা এবং নতুন নতুন শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে যে উদ্ভুত পরিস্থিতি গড়ে উঠবে সেই অবস্থার বিচারে তৎকালীন সময়ে সি পি আই (এম)-কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে সরকারে যোগ দেওয়ার প্রশ্নে। রাজনীতিতে কিছু বিষয় থাকে যার সবটা আগাম ঘোষণা করা যায় না। এটা ভবিষ্যৎবাণীর মতো নয়। এধরনের বিষয় নীতিভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এবং সি পি আই (এম) বস্তুনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে কোনো কুন্ঠা বোধ করবে না। রাজনীতি হলো প্র্যাকটিক্যাল সায়েন্স এবং মার্কসবাদ লেনিনবাদও কোনো আপ্তবাক্য নয়, প্রয়োগের বিদ্যা। স্বাভাবিকভাবেই ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির ওপর অনেককিছুই নির্ভর করবে এবং কিছু সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতেই নিতে হবে।
প্রশ্ন: সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বি জে পি-কে এখনো কতটা বিপদ বলে মনে করে বামপন্থীরা? কংগ্রেসের জায়গায় বি জে পি কি কেন্দ্রে সরকার গড়ার মতো জায়গায় ফিরে আসতে পারে?
বিমান বসু: কেন্দ্রে বি জে পি-র ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর বি জে পি এখনো বিপদ তো বটেই। বি জে পি রাজনৈতিক দর্শন পরিবর্তন না করলে এই শক্তি দেশের বিপদ হিসাবেই অবস্থান করবে। ভারতের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে, জাতীয় সংহতি, অখন্ডতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বি জে পি সবসময়ই বিপদ। আমরা ২০০৪ সালে চতুর্দশ লোকসভা নির্বাচনের পরেও বলেছিলাম, নির্বাচনে বি জে পি পরাস্ত হয়েছে মানে এই নয় যে দেশের সাম্প্রদায়িকতার বিপদ কেটে গেছে। বিগত পাঁচ বছরেও পরিস্থিতির এমন পরিবর্তন হয়নি, যে এই বিপদ কেটে গেছে বলা যাবে।
অন্যদিকে বি জে পি বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে সাহায্য করার নামে যেভাবে দার্জিলিঙ-এ গোর্খাল্যাণ্ড ইস্যুকে ঘিরে ভূমিকা পালন করছে তা এ-রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষা করার ক্ষেত্রে বিপদ হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে।
প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে চলে আসি। এরাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন বেশ উত্তপ্ত। অনেকেই বলছে এবার এরাজ্য থেকে বামফ্রন্টের আসন অনেক কমে যাবে। এমনকি কিছু সংবাদমাধ্যম সি পি আই (এম)-র নিজস্ব ‘বিশ্লেষণ’-র নাম করে বলছে, কিছু সংবাদমাধ্যম জনমত সমীক্ষার নামে বলছে বামফ্রন্টের আসন সংখ্যা ব্যাপক কমে যাবে। এব্যাপারে আপনাদের কি মনে হয়?
বিমান বসু: এরাজ্যের মানুষকে আমরা যতদূর চিনি এবং জানি, তাদের সঙ্গে চলাফেরা করে, কথাবার্তা বলে একথা বলতে পারি, বামফ্রন্টের আসন সংখ্যা কমে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। যদিও কিছু সংবাদমাধ্যম মানুষের মনকে বিষিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। তারা প্রচার করছে, এবার কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের জোট হয়েছে, অতএব এবার তারাই জিতবে। কিন্তু জোট তো নতুন নয়। ২০০১ সালেও জোট হয়েছিলো। ১৯৯৬ সালেও হয়েছিলো। এমনকি ২০০৪ সালেও একধরনের জোট হয়েছিলো। কিন্তু তাতে বামফ্রন্টের আসন কমেনি, বরং বেড়েছিলো। আসল কথা হলো, জোটটা কিসের জন্য? দেশকে, রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য না কি পিছিয়ে দেওয়ার জন্য? মানুষ কী এটা বিচার করতে পারবে না? বামফ্রন্ট বিরোধীরা এবং কিছু সংবাদমাধ্যম রাজ্যের মানুষকে বোকা বানাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা রাজ্যের মানুষকে মূর্খ মনে করি না। এর জবাব তাঁরা নির্বাচনে সুদে আসলে দেবেন।
আরো একটা কথা বলা প্রয়োজন যে এবারের নির্বাচনটা হচ্ছে দিল্লিতে সরকার গড়ার জন্য, ভারতের যে পঞ্চদশ লোকসভা গঠিত হবে তার ৫৪৩জন প্রতিনিধির মধ্যে এরাজ্যের ৪২জন প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করার জন্য। কোনো পঞ্চায়েত, পৌরসভা গঠনের জন্য নয়, অথবা রাজ্য সরকার গঠনের জন্যও না। অথচ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এবং কিছু সংবাদমাধ্যম এমনভাবে প্রচার করছে যেন এটা রাজ্যেরই নির্বাচন, তাদের প্রচারে কোনো জাতীয় বিষয়ের উল্লেখই নেই। দেশ আগামী পাঁচ বছর কিভাবে চলবে, দেশের বিদেশনীতি, অর্থনীতি, শিল্পনীতি, কৃষিনীতি, শিক্ষানীতি, সামাজিক ক্ষেত্রে নীতি কি হবে তা নিয়ে ওদের মুখে কোনো রা নেই। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে কুৎসা ও অপপ্রচারই ওদের মূল হাতিয়ার। মানুষ নিশ্চয়ই এটা বুঝবেন।
প্রশ্ন: কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে, বিরোধীদের জোটে শুধু কংগ্রেস তৃণমূল নয়, অন্যান্য কিছু চরমপন্থী শক্তিও অংশ নিচ্ছে এবং সমর্থন দিচ্ছে। এটা কি আরো ভয়ানক দিক নয়?
বিমান বসু: ভারতে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহান তাঁর ‘এ ডেঞ্জারাস প্লেস’ বইতে লিখেছেন, ১৯৭১ সালে আমাদের রাজ্যের রাজনীতিতে কীভাবে কমিউনিস্টদের ঠেকাতে বিদেশী শক্তির পক্ষ থেকে সরাসরি সাহায্য দেওয়া হয়েছিলো। তারপরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। মানুষের অভিজ্ঞতা বেড়েছে। মানুষ বুঝতে পারছেন দেশী বিদেশী প্রতিক্রিয়ার শক্তি এরাজ্যে বামপন্থীদের অগ্রগতি ঠেকাতে বিরোধিতার শক্তিকে জোটবদ্ধ করে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছে। কথায় বলে নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। এরাজ্যের মানুষ বুঝবেন না কিসে তাঁদের ভালো হবে? তাঁরা জানেন, বামপন্থীরাই জনস্বার্থবাহী কর্মসূচী রূপায়ণ করতে আন্তরিক। দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য কমিউনিস্টরাই বামপন্থী ও অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেস ও বি জে পি-র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। কেন্দ্রের ইউ পি এ সরকার দেশের স্বার্থকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বন্ধক দেওয়ার কর্মসূচীকে আঁকড়ে থাকলে আমাদের তার ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে সময় লাগেনি। তাই দেশ ও মানুষের স্বার্থ রক্ষায় বামপন্থীরা যে ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠা নিয়ে চলে তা রাজ্যবাসী নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন।
প্রশ্ন: দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় প্রায় প্রতিদিনই সি পি আই (এম)-র কর্মী সমর্থক বা নেতারা খুন হয়ে যাচ্ছেন। গত ১৮ই মার্চ একদিনে ৫ জন সি পি আই (এম) কর্মী খুন হয়েছেন। বিরোধীরা বলছে এগুলি নাকি সি পি আই (এম)-র আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল। প্রকৃত কারণটা কি?
বিমান বসু: এধরনের খুন ও হত্যার ঘটনা বামফ্রন্টবিরোধীদের কর্মসূচীতে নতুন নয়। এরাজ্যে বামফ্রন্টের মূল শক্তি সি পি আই (এম)কেই তারা আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু করেছে। দেশী বিদেশী প্রতিক্রিয়ার শক্তি একাজে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। সমাজে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যেই তারা এই অপরাধমূলক কাজ করে চলেছে। আমাদের নেতা-কর্মীরা প্রতিদিন খুন হচ্ছেন, অথচ তৃণমূলসহ বিরোধীরা প্রচার করছে আমরাই নাকি সন্ত্রাস করছি! শুধু গত ১৮ই মার্চ ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমাদের ৫জন নেতা-কর্মী রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে খুন হলেন। এটা কিসের ইঙ্গিত? আসলে বামফ্রন্টবিরোধীরা খুন-সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে রাজ্যে একটা নৈরাজ্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে চাইছে। আমরা এর মোকাবিলায় জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার ও প্রতিরোধ সংগঠিত করবো। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই এই আক্রমণ প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলা হবে। এভাবেই সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলিকে জনগণের কাছথেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। দুএকটি সংবাদমাধ্যম গল্পকাহিনী ছড়িয়ে যে-এলাকায় এই আক্রমণ, তার বাইরে অন্য কোন এলাকায় কিছু মানুষকে ভুল বোঝাতে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু যে এলাকায় এই খুন-খারাপি হচ্ছে, সেই নির্দিষ্ট এলাকার মানুষ জানেন কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা।
প্রশ্ন: লালগড়, দার্জিলিঙ এবং কামতাপুরের নামে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলি চলছে, সেগুলি নির্বাচনে কেমন প্রভাব ফেলবে?
বিমান বসু: এই সব বিচ্ছিন্নতাবাদী ঘটনা স্থানীয়ভাবে কিছু সমস্যা করতে পারে। হয়তো কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় প্রভাবও ফেলতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে রাজ্যে এর কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। তবে লালগড়, দার্জিলিঙ এবং কোচবিহারকে কেন্দ্র করে রাজ্যকে খন্ড খন্ড করার যে চক্রান্ত চলছে, সেই সম্পর্কে বামফ্রন্ট কর্মীদের মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। নির্বাচনী প্রচারে এটা বারে বারে তুলে ধরার প্রয়োজন আছে।পশ্চিমবঙ্গবাসী নতুন করে বাংলা ভাগের কোন চক্রান্তকে মেনে নেবেন না বলেই মনে করি।
প্রশ্ন: বামফ্রন্টের ঐক্যের ঘাটতির জন্য নাকি গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে কিছু জেলায় ফলাফল খারাপ হয়েছে। এবার লোকসভা নির্বাচনের আগে বামফ্রন্টের ঐক্য কেমন রয়েছে?
বিমান বসু: একথা সত্য যে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্ট ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইতে অংশ না নিতে পারায় এবং পরস্পর বিরোধী প্রচার ধারা পরিচালনা করায় মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিলো। এতে যে জনগণের শত্রুরা লাভবান হবে এটা সবাই যথাসময়ে ঠিকমতো বুঝে উঠতে না পারায় এলাকাগতভাবে বামফ্রন্টের ঐক্যের চাপ তৈরি হয়নি। বিরোধীরা কিছুটা লাভবান হয়েছিলো। এক্ষেত্রে বামফ্রন্টের সবশরিক দলের ভ্যন্তরীণ কিছু আত্মসন্তুষ্টি কাজ করেছিলো। এখন পঞ্চায়েতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বামফ্রন্টের ঐক্যকে দৃঢ় করতে সব শরিকদল ঐকান্তিকভাবে প্রয়াসী হয়েছে। বামফ্রন্টও অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াইয়ের ময়দানে সামিল হয়েছে।
প্রশ্ন: সিঙ্গুর থেকে টাটাদের কারখানা তাড়ানো এবং নয়াচরসহ নানা শিল্পপ্রকল্পের বিরোধিতা করছে তৃণমূল কংগ্রেস। নির্বাচনী প্রচারে আপনারা এগুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে কীভাবে তুলে ধরছেন?
বিমান বসু: রাজ্যের অর্থনীতি বিকাশের যে কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে এবং কৃষির উন্নয়ন বজায় রেখে শিল্প বিকাশের কথা, তা নিশ্চয়ই আমরা প্রচারে তুলে ধরবো। সিঙ্গুর রাজ্যের ছোট মোটরযান তৈরির ক্ষেত্রে একটা ল্যান্ডমার্ক হতে পারতো। গত ২৩শে মার্চ মুম্বাইতে ‘ন্যানো’ যে বাজারে ছাড়া হলো তা পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর কারখানা থেকেই দেশে-বিদেশে যেতে পারতো। অথবা ৩১শে মার্চ কলকাতার বাজারে যে প্রচারের জন্য এলো, সেটাও সিঙ্গুর কারখানা থেকেই সরাসরি আসতে পারতো। কিন্তু এরাজ্যের প্রধান বিরোধীদলের শিল্পবিরোধী-উন্নয়নবিরোধী কর্মসূচীর জন্য সেটা হতে পারলো না। তারা রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটিকে ব্যঙ্গ করে বলেছিলো, ‘ন্যানো, কেন?’ এই শিল্পের ফলে যে অসংখ্য অনুসারী শিল্প হতে পারতো এবং তাতে হাজার হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব হতো, তা তারা নস্যাৎ করে দিয়েছে। হাজার হাজার যুবক যুবতীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তারা কেড়ে নিয়েছে। কাজেই আমার মনে হয় না, বিরোধী শক্তিকে রাজ্যের নতুন প্রজন্ম ক্ষমা করবে।
প্রশ্ন: বিরোধীরা অভিযোগ করছে, গ্রামের গরিব মানুষ, তফসিলী জাতি, আদিবাসী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বামফ্রন্ট সরকার নাকি বঞ্চনা করছে। এই ব্যাপারে আপনাদের মত কি?
বিমান বসু: এসব একদম বাজে কথা। গ্রামের গরিব মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা কংগ্রেস আমলে কি ছিলো? আর বামফ্রন্টের আমলে কোন জায়গায় আছে? এই হিসাবটা করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে সত্যিই বামফ্রন্ট সরকার জনস্বার্থবাহী কাজ করেছে কিনা। কংগ্রেসের আমলে যেখানে গ্রামের মানুষের শিল্পজাত পণ্যের ক্রয়ক্ষমতা ছিলো মাত্র ৪-৫ হাজার কোটি টাকার, সেখানে এখন তা বেড়ে ২০-২২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এটা কোন যাদুতে হয়েছে? জমিদার জোতদারদের বেআইনী খাস জমি ও বেনামী জমি উদ্ধার করে গ্রামের গরিবের মধ্যে তা বন্টন করা হয়েছে। এর ৭০ শতাংশই তো তফশিলী জাতি, আদিবাসী, ও ধর্মীয় বিচারে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজনদের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে। এই জমিতে যে সোনার ফসল হচ্ছে তার উপকার তো এই সব অংশের মানুষ প্রত্যক্ষভাবে পেয়েছেন। তাছাড়া বেশীরভাগ গ্রামে পরিশ্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশু শিক্ষা কেন্দ্র, জুনিয়র হাইস্কুল, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল হয়েছে। কলেজের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। কংগ্রেস আমলে তিন লক্ষের বেশি মাধ্যমিক পরীক্ষা দিত না। এখন প্রতি বছর ৮লক্ষ ছাত্রছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ সরকারী পরিকাঠামো থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবা পান। এইসবের উপকার তো গ্রামের তফসিলী জাতি আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই পাচ্ছেন। এইসব দিক বিচার বিবেচনা করে সামগ্রিকতার দৃষ্টিতে উন্নয়নের দিকটি দেখতে হবে। তাহলেই বোঝা যাবে বামফ্রন্ট সরকারের কাজের অভিমুখে সমাজের দুর্বলতর অংশের মানুষ কত গুরুত্বপূর্ন স্থান নিয়ে রয়েছে।