১৭ ওই সকাল থেকেই (আগেই প্রস্তুতি ছিলো) সারা পশ্চিম বঙ্গ তে অন্ধকারের জিবরা নখ , দাঁত বার করেছিল আর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সি পি আই এম কর্মিদের ওপর। সেদিন সকাল থেকেই শুরু হয় আক্রমণ , চারিদিকে আহত এবং নিহত হতে থাকেন কমরেড গন। নৈহাটির গৌরিপুর জুট মিলের গেটে পিকেট করতে গিয়ে গুলি খান কর্মিরা, শ্রমিকেরা, কয়েকজনের প্রানহানিও হয়। টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা ঘটে যায় সারা বাংলাতে। এরই মধ্যে কুন্তিঘাট স্টেশনে কমরেড ননী দেবনাথ কে মেরে টানতে টান্তে নিয়ে গিয়ে কেশরাম রেয়নের বয়লারে ফেলে দেওয়া হয়। এর পর থেকে নেমে আসে আঘাতের পর আঘাত। এলাকার পর এলাকাতে শুরু হয় গুন্ডাদের সাথে পূলিসের ঘোরা-ঘুরি, আরেস্ট, মিথ্যা মামলাতে জড়িয়ে দেওয়া, মারধর আর খুন। কিন্ত সব থেকে উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা ঘটে বর্ধমানে, আমাদের একটা মিছিল যাচ্ছিল বন্ধের সমর্থনে সকাল ৮ টা - ৯ টার সময়ে। পাশ দিয়ে এ কটা মৃতদেহ নিয়ে কয়েকজন যেতে চান।, পথ ছেড়ে দেওয়া হয়। তারা মিছিলের সামনে গিয়ে মড়ার খাটিয়াটা নামিয়ে রাখে, মড়ার ওপরের ঢাকা সরিয়ে রেখে দিয়ে বোম লাঠি এসব কাজে লাগানো হয়, প্রথম আহত হয় গৌরি রায়, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সেখানে তাকে আরেস্ট করা হয়। গৌর হরি যখন আহত হয়ে ভর্তি হয় তখন সাঁইবাডি তে কিছু ঘটে নি!
এরপর সাঁবাড়ির (কাছেই ছিলো তখন) ওপর থেকে গরম তেল আর জল (আগের থেকেই প্রস্তুতি ছিল, জড় হয়েছিলো সমাজবিরোধিরাও) ঢালা হয় মিছিলের ওপর, ভেতর থেকেই ইট আর বোম ফেলা হয়। এর পর মিছিলকে আটকানো সম্ভব ছিলো না, সেরকমও কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতাও ছিলেন না ওই মিছিলে। মিছিল ঢোকে বাড়িতে আর বাড়ির লোকেদের ওপর হামলা করে। সংঘর্ষে ২- ৩ জন মারা যান। রাত থেকে ই শুরু হয় আরেস্ট এর ওপারেসন আর ঘন্টায় ঘন্টায় ক্রমবর্ধমান তালিকা সম্বলিত এফ আই আর! রোজই নাম বাড়তে থাকে আর নতুন নতুন ওয়ারেন্ট বেরোতে থাকে। শুধু শহর নয়, সংলগ্ন গ্রামগুলিও চলে যায় পূলিসের বুটের তলায়। এই ঘটনার পর ব্রিগেড এর সভাতে কমঃ হরেকিষান কোঙ্গার বলেছিলেন “ আমি গর্বিত বর্ধমানের ছেলেদের জন্যে, তারা মারের মুখে ছুটে পালায় নি, তারা প্রতিরোধ করেছে আর সেই প্রতিরোধ করতে গিয়ে কিছু ঘটে থাকলে তা আইন এ স্বীকৃত আত্মরক্ষার অধিকার প্রতিষ্টা করা” ( ভাষা টা এক নাও হতে পারে তবে এটা ছিলো তাঁর বক্তব্য) ।
এই সন্ত্রাস কবলিত বর্ধমান শহরে ৩ রা এপ্রিল মিটিং হয়, বিশাল, সেখানে অভূতপূর্ব ভাবে বক্তা ছিলেন কমরেড প্রমোদ দাসগুপ্ত, জ্যোতি বসু আর হরেকিষান কোঙ্গার একই মঞ্চে। সেই বক্তৃতা তি আর্কাইভ করবার ব্যাবস্থা করেছিলেন কমরেড রা, দিকে দিকে সংগ্রামী জনগন এর কাছে ছড়িয়ে দিতে।
হরেকৃষ্ণ কোঙারের একটি বক্তৃতার লিংক - http://www.esnips.com/web/
প্রচারমাধ্যম তার উপযুক্ত ভূমিকা পালন করেছিল মিথ্যা কাহিনী আর নাটকীয় ছবি সাজিয়ে সি পি আই এম কে খুনির দল হিসাবে দেখানো, ক্লান্তিহীন ভাবে কাজ করে গেছে এই বাজারই কাগজগুলি। আনন্দবাজারে একটা ছবি বেরিয়েছিল, ঘটনার পরের দিন, নবকুমার সাঁই মৃতদের দাদা বোধহয়, তার চোখে ব্যান্ডেরজ, ঘটনার পরের দিন, তার চোখ নাকি খুবলে তুলে নিয়েছে সি পি আই এম এর খুনিরা আর চোখে এইয়াসিড ঢালা হয়েছে। ১৫ দিন পর আবার আনন্দবাজারেই ছবি সমেত ওই নবকুমারের চিত্রের একটা মিটিং এ বক্তৃতা দেওয়ার খবর ছাপা হয়েছিলো, কোথাও কোনো ব্যান্ডেজ ছিলো না !!! রাজ্যপাল গিয়েছিলেন কনভয় আর সংবাদমাধ্যম নিয়ে নাকি-কাঁদতে, প্রেসের সামনে তিনি অনেক নাটক করেছিলেন। এর পরের দিন থেকে শুরু হয়েছিলো গ্রামে গ্রামে খাস জমি পূনর্দখল, যেগুলো জোতদার দের হাথ থেকে কেড়ে নিয়ে ভূমিহীন দের বিলি করা হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে ( যা ছিল আমাদের ওপর আক্রমণের সবথেকে বড় কারণ)। তারপরের ৭ বছরের লম্বা- নিদারূণ ইতিহাসের কাহিনি সবারই যানা। সেইগুলো আরেকবার বলার কোনো কারণ নেই আপাতত। একদম শেষের দিকে আসি।
১৯৭৭ এ ইন্দিরা হারার পর কেন্দ্রে অ-কংগ্রসী সরকার হয়েছিল, কিন্তু তখনও এখানে সিদ্ধার্থ- সরকার! আমি (বাড়ি-ছাড়া) সাউথ সিথিতে থাকি। আমরা কেউ ই যেখানে থাকতুম সেখানে কোনো রাজনৈতিক কাজকর্ম দেখাতুম না, আর ওখানে ছিলই না।। একদিন মাঝ রাতে বোমের আওয়াজ়ে ঘুম ভাঙ্গে, দেখলাম রাস্তায় একটা বাচ্চা ছেলে চকলেট বোম ফাটাচ্ছে, জিজ্ঞ্যাস করাতে বললে, যানেন একটু আগে ফল বেরোলো, ইন্দিরা আর সঞ্জয় দুটোই হেরে গেছে, ওকে শুধু বললাম ঘরে ঢুকে পড়ো, বলে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে সব পরিষ্কার হলো, কংগ্রেস হেরেছে, মানে জরুরি অবস্থার অবসান, মানে তাহলে আমরা কি বাড়ি ফিরবো? এর আগে (জুলাই ‘ ১৯৭১ থেকে) এটা ভাবতেও পারছিলুম না। কয়েদিন বাদে একটা ছেলে এল, পাড়াতে দেখেছি ওকে, মাঝে মাঝে, বললে আপনার নামে চিঠি আছে, নিলুম, দেখি পার্টির নামে একটা চিঠি, আমাকে লেখা, যে অমুক তারিখে নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়াম যেতে হবে, মিটিং আছে, আমি ওকে বললুম, এসব কেনো, আমি তো তোমাদের পার্টি করিনা ( তখন আমাদের ওপর নির্দেশ আছে খোলাখুলি পার্টির পরিচিতি না জানাতে)। আর এসব কোরছো, প্রাণ ভয় নেই? সে বললে, না নেই। আপনি যাবেন। আমি তারিখ আর সময়টা দেখে ওটা ফেলে দিলুম, ভাবলুম এরকম কি করে হয়? আমাকে কে চেনালো? পরে জানলুম, পার্টির কর্মিরা সমূর্ণভাবে পাড়া ছাড়া ছিলো, কিন্তু লোকালে মানে এল সি তে হিসাব ছিলো, কে কে অন্য জায়গা থেকে পালিয়ে এসে এখানে আছে, যদিও তারা সব ক্ষেত্রে এটা জানতেন না যে কে কোন যায়গা থেকে এসেছেন। কি ব্যবস্থাপনা, কি নেটওয়ার্ক!!! গেলুম ইন্ডোরের মিটিং এ। দুই জন বক্তা, প্রমোদ দাসগুপ্ত আর জ্যোতি বসু। মোট মিটিং হ্ল তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিটের! দুইজন একই কথা বললেন
- “গত ৫ বছরে কংগ্রেস এখানকার মানুষকে অনেক অশান্তির আর রক্তপাত দেখিয়েছে, তাঁরা যেনো আর কষ্ট না পান। কোনো প্রতিশোধ নেওয়া চলবে না। মাথা নিচু করে যান মানুষের কাছে, ভেঙ্গে যাওয়া সংগঠন ঠিক করুন, সামনে বিধান সবার নির্বাচণ আসছে, আমাদেরও অ-কংগ্রেসী সরকার প্রতিষ্টা করতে ই হবে।” এর দুই দিন পর বাড়ি ফিরলুম, স্টেশন থেকে নেমে আমি আর আমার দাদা স্কুলে গিয়ে শিক্ষক দের সাথে দেখা করলুম, বাড়ি গেলুম, জঙ্গল চারদিকে, বাড়ির অনেক কিছুই ভেঙ্গে নিয়ে গেছে!! আর বিকালে দেখলুম রাস্তায় বেরলে লোক-জন আমাদের কাউকে দেখলে রাস্তার উলটো দিক দিয়ে পালাচ্ছে!! পাছে কথা বললে খুন হতে হয়! এবং যাদের জন্যে পাড়া ছাড়া হতে হয়েছিলো, তাদেরকেও দেখলাম। অনেক মিইয়ে গেছে যদিও। মানে সেই খুনিদের সামনে দেখেও আমরা কিছুই করি নি, ক্ষমতা প্রথম দিকে ছিল না, পরে এল, কিন্তু তারা নিরাপদেই থাকলো এলাকাতেই!! (পার্টি এরকমই নির্দেশ দিয়েছিল)।