Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

বেসিক্যালি আমি 'অ্যাপোলিটিকাল' ~ সুশোভন পাত্র


বেসিক্যালি আমি 'অ্যাপোলিটিকাল'। মোটা দাগে 'অরাজনৈতিক'। শ্রী শ্রী বব মার্লে আমার গুরু আর শাকিরা আমার রাধে মা। আমার বাথরুমের পাশে ষ্টার-জলসা। জীবন মানেই জি-বাংলা। আমি গাছেরও খাই, তলারও কুড়োই। ডালে-ঝোলে-অম্বলে সবেতেই আমি আছি। আদা আর কাঁচকলা দুটোই আমার সমান পছন্দের। আমি সাপের মাথায় চুমু খাই, নেউলের গায়েও হাত বোলাই। চায়ের দোকানে দেশ-দুনিয়ার খবর শুনে, জীবন ও জীবিকার সমস্ত সমস্যার দায়, সিস্টেমের উপর চাপিয়ে, পিছনে দুটো ইংলিশ গুঁজে, চায়ের কাপে ঝড় তুলে, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলি "ডার্টি পলিটিক্স। দিস হোল ব্লাডি সিস্টেম ইস ক্র্যাপ।"... উফ কি শান্তি যে পাই! ঐ যে বললাম, বেসিক্যালি আমি 'অ্যাপোলিটিকাল'। 



৯৫-১৩ অবধি ভারতবর্ষে ২,৯৬,৪৬৬ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। সংখ্যাটা ইডেন গার্ডেনসের কানায় কানায় পূর্ণদর্শক সংখ্যার ৩ গুন, ভারতবর্ষের প্রমাণ মাপের ট্রেনের, মোট যাত্রী সংখ্যার ২০০ গুন কিম্বা যেকোনো এয়ারবাসের সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতার ৬০০ গুন। সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় কৃষক আত্মহত্যার প্রবণতা ৪৪% বেশী। গত ফেব্রুয়ারিতে মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গবাদ ডিভিশনেই আত্মহত্যা করেছিলেন ১৩৫ জন কৃষক। মার্চে আমাদের রাজ্যেই ঋণের দায়ে আরও ১৬ জন আলুচাষী। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রক, রাজ্যসভায় লিখিত উত্তরে জানিয়েছে, কৃষক মৃত্যুর কারণ নাকি "পুরুষত্বহীনতা" এবং "প্রেমে ব্যর্থতা।" এক গেরুয়া সাংসদ বলেছেন "কৃষক মরছে মরুক। যারা পারবে তাঁরা করবে, যারা পারবেনা তাঁরা মরবে।" আর রাজ্য সরকার বলেছে তাঁরা কোনও আলুচাষীর আত্মহত্যার খবর জানেনই না। 

কিন্তু, রাজ্যসভা তো দূরের কথা, পাড়ার দুর্গাপূজার সাধারণ সভার খোঁজই আমি রাখি না। দেশ তো কোন ছার, পাশের ঘরের সিপিএমটা রাম ক্যালানি খেলে দেখতে অবধি যাই না। আমি তো আর কৃষক নই, ঔরঙ্গবাদ ডিভিশন কোন চুলোয় তাও জানি না, কস্মিন কালে মহারাষ্ট্র যায়নি, আলুচাষও করিনি। সুতরাং কৃষক আত্মহত্যায় আমার কি আর বয়ে গেলো? শুধু গেঁয়ো চাষিগুলো, কলকাতা গিয়ে রাজপথে নিজেদের দাবির জন্য হ্যাংলামি করে শ্লোগান দিলে, ছ্যাবলামি করে মিছিল করলেই, বাংলার 'কৃষ্টি, সংস্কৃতির আর ঐতিহ্যের' কথা ভেবে লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে যায়, জানেন। কারণ, ঐ যে বললাম বেসিক্যালি আমি 'অ্যাপোলিটিকাল'। 

গতবছর উত্তরবঙ্গের রায়পুর চা বাগানে, না খেতে পেয়ে, তিস্তার পাড়ে, চিতা জ্বলেছিল ৩৭ জন শ্রমিকের। রাজ্য শ্রমদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী ২৫৭টি লক আউটে নষ্ট হয়েছে ১৫৭ লক্ষ শ্রম-দিবস। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৯১ হাজার শ্রমিক। গত ৩০ বছরে জাতীয় আয়ে, শ্রমিকের মজুরির ভাগ কমে হয়েছে ৩০% থেকে ১৩% আর পুঁজিপতিদের বেড়ে হয়েছে ২০% থেকে ৫০%। তবু কর্পোরেটদের পকেট ভরাতে, ট্রেড ইউনিয়ন গুলির সাথে আলোচনা করার চিরাচরিত রীতি কে বাইপাস করে, 'উন্নয়ন' আর 'সংস্কারের' দোহাই দিয়ে, কেন্দ্রীয় সরকার, ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট -১৯৪৮, অ্যাপ্রেন্টিস অ্যাক্ট-১৯৬১, কন্ট্রাক্ট লেবার-অ্যাক্ট-১৯৭০, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট অ্যাক্টে-১৯৭০-এ ব্যাপক রদবদলের প্রস্তাব এনেছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে দেশের প্রায় ১৫ কোটি শ্রমিক। 

কিন্তু আমি তো চা বাগানের শ্রমিকও নই, জুট মিলে কাজও করিনা, ন্যুনতম মজুরি নিয়ে আমাকে রাষ্ট্রের কাছে হাতও পাততে হয় না, ওভারটাইমও করতে হয় না। আমার ঝুঁকিহীন জীবনে, বিমা আছে, মেডিক্লেমও আছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী জামাইষষ্ঠী তে, সরকারী আপিসে হাফ ডে ছুটি ঘোষণা করলে, আমার 'কর্ম সংস্কৃতির' কথা মনে না পড়লেও, হা-ভাতে শ্রমিক গুলোর 'কর্মনাশা' ধর্মঘটে দেশের অর্থনীতির ক্ষতির কথা ভেবে রাতে কিছুতেই ঘুম আসে না। ঐ যে বললাম বেসিক্যালি আমি 'অ্যাপোলিটিকাল'। 

কৃষকের মৃত্যু কৃষকের, শ্রমিকের ঘাম শ্রমিকের, বেকারের দাবি বেকারের। আমার 'ধরি মাছ না ছুঁই পানির' দুনিয়ার রঙিন দূরবীনে,যা কিছু 'অধম' তার দায় আপনার, কিম্বা তাঁদের, আর যা কিছু 'উত্তম' তার কৃতিত্ব শুধু আমার আর আমাদের। তাই টেট পরীক্ষা হলো না বানের জলে ভেসে গেলো, প্রশ্নপত্র চুরি হলো না ডানা মেলে চলন্ত বাস থেকে উড়ে গেলো, কার ৪৮%'এ কোন ক্লাব পয়সা পেলো, সেটা আমার ইষ্টিকুটুমের সোনার সংসারের সানন্দীয় পেলবতায় কোন আঁচড়ই কাটে না। কারণ বেসিক্যালি আমি তো 'অ্যাপোলিটিকাল'...

ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks