বাবুসোনা ইশকুলে রোজ মার খেতো। মার বলে মার? সাধু স্যারের খেজুর ছড়ির মার, হেডস্যারের ডাস্টারের বাড়ি, লক্ষিকান্ত স্যারের কানমোলা, এমনকি রামচন্দ্র স্যারের মত ভালমানুষ লোকের কাছেও চড়-থাপ্পড় জুটিয়ে নিত কিছুনা কিছু করে। কিন্তু এত মার পড়া সত্ত্বেও বাবুসোনা একটা দিনের জন্যেও বদমায়েশি বন্ধ করেনি। মার খেয়েও বসে পড়তনা, মার এড়াতে চেষ্টা করতনা। চোখে চোখ রেখে শাস্তি নিতো প্রতিবার। ক্লাস সিক্সে উঠে দুজনের আলাদা আলাদা ইশকুল হয়ে গেল। মাঝের ক বছর আর তার দেখা পাইনি। শেষে উচ্চমাধ্যমিকের সময় আবার দুজনে একই ইশকুলে একই ক্লাসে এসে বসলুম। তখন অবিশ্যি বয়স অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু কদিন যেতেই বুঝলুম, বাবুসোনা বদলায়নি। নিয়ম না মানায় সিদ্ধহস্ত বাবুসোনা নিয়ম করে কিছুনা কিছু করে বসত যাতে গোটা ইশকুলে হুলুস্থুলু । হাজার শাস্তি পেয়েও সে শুধরোয়নি। এরকম একবগগা ছেলে খুব কমই দেখেছি।
একবগ্গা লোকজন, যাঁরা বার বার বাধা পেলেও সেই কাজটাই করে চলেন, যেটা তাঁদের মন চায়, তাঁদের আমার দিব্যি লাগে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা সকলেই অল্পবিস্তর ওই ধরনের। এই যেমন আমি প্রতি মাসেই নিয়ম করে চেষ্টা চরিত্তির চালিয়ে যাই, আমার লেখা যেন একটু পাতে দেবার মত হয়, পদের হয়। গত ক বছরের ক্লান্ত ব্যার্থ প্রচেষ্টার পরেও ক্ষান্তি দিইনি। আবার কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের ক্ষেত্রে দেখেছি, তাঁদের এই একবগ্গা ব্যাপারটা যখন প্রায় আমাদের অভ্যেসের মধ্যে চলে এসেছে, ঠিক তখনই তাঁরা এমন একটা কিছু করে বসেন, যে আমাদের হাতে থাকে কেবল পেনসিল, আর লোকটার সম্পর্কে ধারনা আবার কেঁচেগন্ডুস করতে হয়। এই যেমন ধরুন স্টিভেন স্পিলবার্গ। সেই হাফ পেন্টুল পরা সময় থেকে লোকটাকে চিনি বেশ শিরশিরে অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার, কল্পবিজ্ঞান আর ছোটোদের অসম্ভব সব ভাল লাগার ছবি তৈরি করেন। জস, ক্লোজ এনকাউন্টার অফ দ্য থার্ড কাইন্ড, ইটি, ইন্ডিয়ানা জোন্সের ছবিগুলো, ইনারস্পেস, হুক, জুরাসিক পার্ক। কত আর বলি? স্টিভেন স্পিলবার্গ মানেই জমাটি অ্যাডভেঞ্চার আর দম আটকানো ঠাশ বুনটের বিরল হলিউডি ছবি, যা বাড়ির আর সকলের সঙ্গে, একসঙ্গে দেখা যায়। কথায় কথায় নায়ক নায়িকা জামাকাপড় খুলে বিটকেল L এর মত চাদরের তলায় ঢুকে পড়েনা। L এর আকারের চাদর অবশ্য আধুনিক হলিউডে বড়ই অপ্রতুল। আজকাল এসবের আর দরকার পড়েনা কিন্তু আগে ছবিতে প্রায়ই দেখা যেত একটিই সরু চাদর, বিছানায় নায়কের দেহের নিতম্বের অংশটুকু ঢেকে রেখেছে, আবার সেই চাদরই যাদুবলে নিরাবরন নায়িকার কাঁধের নিচে থেকে হাঁটু পর্যন্ত চাপা দিতে পেরেছে।
স্পিলুবাবুর ছবিতে অন্য গ্রহের প্রানীরা মানুষের বন্ধু হয়, চকোলেট খায়, গান শোনে, টমেটো আর আপেল দিয়ে সৌরজগত তৈরি করে। ইটি কিম্বা ক্লোজ এনকাউন্টারে সেরকমই দেখেছি। আর ছোটোদের সঙ্গে তাদের পটে বেশী, বড়দের বড়ই সন্দেহ বাতিক কিনা, ছোটোদের সে সবের বালাই নেই। আর যেমন অ্যাডভেঞ্চারই হোক না কেন, বাড়ি-বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে সব সমেত একটা নিটোল পারিবারিক ব্যাপার থাকবেই সে সব ছবিতে। এমনকি স্কুল, মাস্টারমশায়, স্কুল ফাঁকি, পড়ায় মন না বসা সব কিছু। এসবের ভেতর দিয়েই নিজেকে চিনে নিতে পারতাম ছবিগুলোয়। আর স্পিলুবাবুকে খুব চেনা মনে হতো। জুরাসিক পার্ক দেখেছিলাম যমুনায়। সে যমুনা আর নেই। এখন বিয়েবাড়ি হিসেবে ভাড়া দেয়। বড় পছন্দের ছিল যমুনা সিনেমাহল। জুরাসিক পার্ক দেখে বেরিয়ে বুঁদ হয়েছিলাম। বরাবর ফ্যান্টাসি, কল্পবিজ্ঞান এসবের ওপর প্রবল আকর্ষন আমার। ছোটোবেলায় মাটি দিয়ে ডায়নোসর তৈরি করতুম। সেগুলো কে স্পিলুবাবু এভাবে জীবন্ত করে পর্দায় হাজির করে দেবেন, সেটা অবিশ্বাস্য। স্পিলবার্গের পরের ছবির অপেক্ষায় দিন গোনা শুরু আবার। এমন সময় খবর এল নন্দনে একটা ছবি এসেছে , পরিচালক স্পিলবার্গ। তখন ইন্টারনেটের যুগ শুরু হয়নি। আর আমাদের পত্রপত্রিকায় হলিউডের স্থান বড়ই কম। যেহেতু স্পিলবার্গ, চলে গেলুম দেখতে। প্রায় ফাঁকা হলে বসে ছবিটা দেখে বেরিয়ে বাড়ি যেতে পারলাম না। ময়দানের ধার দিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে বাবুঘাট গিয়ে গঙ্গার ধারে অন্ধকারে বসে রইলাম অনেক্ষন। একা। আমার, সিনেমা সম্পর্কে ধারনা, স্পিলবার্গ সম্পর্কে ধারনা, ইতিহাস সম্পর্কে ধারনা, মানুষ এবং জীবন সম্পর্কে ধারনা এত অল্প পরিসরে এতটা বদলে যেতে আর দেখিনি। ছবিটা অবশ্য পরের সপ্তাহেই হইহই করে এক গাদা অস্কার পেয়ে গেল, আর গোটা কলকাতা ছুটল নন্দনে “শিন্ডলার্স লিস্ট” দেখতে। এতদিনের ফ্যান্টাসি-কল্পবিজ্ঞানের জাদুকর স্টিভেন স্পিলবার্গ নিজেকে ভেঙ্গে চুরে শেষ করে দিলেন।
ভেঙে ফেললেন না গড়ে তুললেন সে নিয়ে অবশ্য বিতর্ক চলতেই পারে। শিন্ডলার্স লিস্ট, তার পরে অ্যামিস্টাড, শেষে সেভিং প্রাইভেট রায়ান। যত সময় এগিয়েছে, তত বেশী তথ্য ও ইতিহাস নিষ্ঠ হয়েছেন স্পিলবার্গ, আর তত বেশী মানবিক আবেদন এসেছে তাঁর ছবিতে। দাস মজুর খাটানো পুঁজিবাদী মুনাফাখোর মার্কামারা নাৎসি কাঁদতে কাঁদতে আফশোষ করে, সোনার কোট পিন ঘুষ দিয়ে আরো একটা ইহুদির প্রান বাঁচানো যেত। শনের মত সাদা চুল দাড়ি সমেত গোলাপি চামড়া নীল চোখের ধনী রিপাবলিকান সেনেটর ও উনবিংশ শতকের প্রাক্তন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি, বৃদ্ধ বয়সে বেওয়ারিশ কালো আফ্রিকান দাসদের মুক্তির সপক্ষে সওয়াল করতে অশক্ত শরীরে আদালতে হাজির হন। বহু রক্তক্ষয় পেরিয়ে অসাধারন বীরত্বে জয় করা জমিতে শুয়ে বিজয়ী ফৌজি ক্যাপ্টেন মুমুর্ষু অবস্থায় এক সাধারন সিপাহীকে বলেন , “এসব ছেড়ে স্রেফ বাড়ি ফিরে যাও”। মিউনিখ ছবিতে (মুনষেন। মিউনিখ বলে ইংরিজি অশিক্ষিতরা) ইজরায়েলি খেলোয়াড়দের হত্যাকারী ব্ল্যাকসেপ্টেম্বর গ্রুপের মাথাদের নিকেস করে প্রতিশোধ নিতে থাকা মোসাদ অফিসার নিজের পরিবার নিয়ে বহু দূরে অজ্ঞাতবাসে গিয়ে যখন টের পায়, সেখানেও মোসাদ তার ওপর নজর রাখছে, তখন সব গোপনীয়তার শপথ ভুলে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানায় এই খুনের রাজনীতির।
কিন্তু এসবের পরেও স্পিলুবাবু আমাদের জন্যে নিয়ে এসেছেন টার্মিনালের মত ছবি। যেখানে সেই অর্থে কোনো ক্লাইম্যাক্স নেই, বিপদ বলতে আছে আমলাতান্ত্রিক নিয়মের লাল ফিতের ফাঁস আর অন্যদিকে একজন সহজ সরল সাধারন মানুষ। যার সারল্যই তার নির্ভিকতা। আর সেই সারল্য দেখে, সাহস দেখে অনুপ্রানিত হয়ে চেন্নাই থেকে তোলাবাজ খুন করে ফেরার হওয়া বৃদ্ধ পানওয়ালা রাজন, বহু যুগ পরে নিউইয়র্ক শহরে পুলিশের হাতে ধরা দেবার মত মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে। ছবিতে একের পর এক সম্পর্ক তৈরি হয় কতগুলো অচেনা মানুষের মধ্যে, যার হয়ত কোনো নাম হয়না, হতে পারেনা। আর মানবিক মুখ মূর্ত হয়ে ওঠে যখন ভাষা, বর্ণ, দেশ, পোশাক, পাশপোর্টে আলাদা হয়ে থাকা বিশাল এয়ারপোর্টের সমস্ত মানুষ, আটকে পড়া যাত্রি ভিক্তর নোভোর্স্কির কষ্টে কষ্ট পায়, আনন্দে খুশি হয়। ক্যাচ মি ইফ য়ু ক্যান ছবিতে কিশোর অপরাধী সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসতে চেয়েছে। তার সেই ইচ্ছের ওপর ভরসা রেখে তদন্তকারি অফিসার ঠকেননি। কিশোর বয়সের জন্য ছবি ওয়ার হর্স। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে ছেলেকে হারানো ফরাসি বৃদ্ধ নিজের সব সঞ্চয় দিয়ে নিলামে কষাইয়ের কাছে বিক্রি হতে থাকা ঘোড়া কিনে সদ্য যুবা আসল মালিকের হাতে ফিরিয়ে দেন। স্পিলবার্গের ছবিতে এ যাবৎ মানবিক মুখগুলো বড় স্পস্ট। এযাবৎ বলছি, স্পিলবার্গের শেষ ছবিটি দেখার আগে পর্যন্ত। ব্রিজ অফ স্পাইজ।
ব্রিজ অফ স্পাইজ। ছবিটা দেখার আগেই পোস্টার দেখেছিলাম। পোস্টারে জ্বলজ্বলে সোভিয়েত ও আমেরিকান পতাকা। প্রথমটা ভেবেছিলাম বুঝি গা শিরশিরে, ঠান্ডা যুদ্ধের পটভুমিকায় একটা গুপ্তচরগিরির ছবি দেখব। কিন্তু পরে জানলাম ব্যাপারটা আদপেই সেরকম নয়। হলিউডি ছবিতে দেখা গুপ্তচরেরার অসাধারন। দেখলেই তাক লেগে যেতে বাধ্য। সে গ্রেটা গার্বো অভিনীত মাতাহারিই হোক, বা একেবারে আধুনিক ড্যানিয়েল ক্রেগের জেমস বন্ড। সৌন্দর্্য্য, কেতা, চলনবলন, কথাবার্তা, চাউনি, বুদ্ধি, সব কিছু দিয়ে তাঁরা বাকিদের থেকে আলাদা। অন্যদিকে স্পিলবার্গের গুপ্তচর নেহাতই ম্যাদামারা। টেকো, বিচ্ছিরি চশমাচোখে, ঝলঝলে জামাকাপড় পরা একটা বেঁটে কুঁজো মত লোক, যে কিনা কাজে কম্মে বেজায় ধীরগতি। সোজা বাংলায় বললে দাঁড়াবে – নিড়বিড়ে আর ক্যাবলা। তার ওপরে আবার ছবির প্রথম দৃশ্যে সেই গুপ্তচর, আমেরিকান এফবিআই এজেন্টদের হাতে ধরা পড়ে যায়। উইলিয়াম ফিশার যাঁর অন্য নাম, রুডলফ আবেল, তিনি কিন্তু বাস্তবের গুপ্তচর। হাজার বার দেখলেও তাঁকে রাস্তার আর পাঁচটা লোকের থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। আর স্পিলবার্গের এই ছবিও কাল্পনিক নয়, দস্তুর মত সত্যি ঘটনার চলচ্চিত্রায়ন। বাস্তব বলেই, স্পিলবার্গের গুপ্তচরকে সাধারন মানুষের থেকে আলাদা করা যায়না। ঝাঁকে মিশে থেকে দৃষ্টি এড়াবার কৌশল এনার জানা। ইন্টারনেটে রুডলফ আবেলের কিছু ছবি আছে। পাঠক খুঁজে দেখতে পারেন।
রুডলফ আবেলের ভুমিকায় মার্ক রাইল্যান্সকে দেখে চমকে উঠতে হয়। মনে হয়, ইতিহাসের পাতা থেকে আসল লোকটাই বোধহয় উঠে এসেছে। পর্দায় রুডলফ আবেলের চরিত্রের গভীরতা প্রকাশ পায় সময়ের পরতে পরতে। এত কম সংলাপে এত গভীর চরিত্রায়ন আমি আগে দেখিনি। বাহ্যিক চেহারা সম্পর্কে আগেই বলেছি। ছবিতে রুডলফ আবেল একজন চিত্রকর। দুর্দান্ত কিছু হাতে আঁকা তেলরঙের ছবি এসেছে ঘুরে ফিরে। একেবারে শুরুতেই এফবিআই এর লোকজন কর্নেল আবেল কে ঘরে ঢুকে গ্রেফতার করে। কেজিবি তে(কেজিবি - কমিতাত গসুদার্স্তভানোই বোজোপাসনস্তি – রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগ – সোভিয়েত ইউনিয়ন) রুডলফ আবেলের পদমর্যাদা ছিল কর্নেলের। ডাকাবুকো গোয়েন্দা বিভাগ বলে এফবিআই এর খ্যাতি আছে। তাদের গোয়েন্দারা প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন এবং সজাগ। কিন্তু ঘরে আচমকা হানা দেওয়া এক গাদা এহেন গোয়েন্দাকে এক কথায় বোকা বানিয়ে কর্নেল আবেল রঙের প্যালেট পরিস্কার করার অছিলায়, ছোট্ট কাগজের টুকরোয় লেখা চরম গোপনীয় কিছু তথ্য নষ্ট করে দেন। সম্পুর্ন অবিচলিত চিত্তে। এই জায়গাতেই প্রথম বারের মত রুডলফ আবেলের চরিত্রকে তুলে ধরেন স্পিলবার্গ।
আমেরিকান সরকার ঠিক করে, তারা গোটা বিশ্বকে দেখাবে, যে বিদেশী গুপ্তচরও মার্কিন বিচার ব্যবস্থায় সমান অধিকার পায়। এ অবস্থায় দরকার পড়ে একজন উকিলের, যিনি আবেলের হয়ে লড়বেন। খুঁজেপেতে মার্কিন বার অ্যাসোসিয়েসন বের করে উকিল জেমস ব্রিট ডনোভানের নাম। ইতিহাস চর্চা হয়, এরকম কিছু লেখালিখির আড্ডায় সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, জেমস ডনোভান কে ইচ্ছে করেই দায়িত্ব দেওয়া হয়, যাতে তিনি কেস লড়তে না পারেন। কারন তিনি আদতে বিমা সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমা নিয়ে লড়ে থাকেন। স্পিলবার্গ অযথা এসব বিতর্কে যাননি। স্পিলবার্গের পরিমিতি বোধ নিয়ে হয়ত একটা গোটা বই লিখে ফেলা যাবে। যে হারে স্পিলুবাবুর স্তুতি গাইছি, তাতে পাঠকের মনে হতে পারে, মানিক রায়ের “এলিয়েন” গল্প নিয়ে হলিউডে ছবির পরিকল্পনা, আর তার কিছু বছর পর স্পিলবার্গের হাত ধরে ইটির আবির্ভাব আমি হয়ত ভুলে মেরে দিয়েছি। দিইনি। ছবির একেবারে শেষের দিকে রুডলফ আবেলকে জেমস ডনোভান্ জিজ্ঞেস করেন, সোভিয়েত দেশে ফিরে গেলে, আবেলের কোনো বিপদ আছে কিনা? আবেলের উত্তর আমার অনেক কাল মনে থাকবে – “I have acted honorably. I think they know that. But sometimes people think wrong. People are people”। এলিয়েন থেকে ইটি, আমি বলার কে? আমি নেহাতই একজন সাধারন মানুষ, “People”। আর “People are people”। আমিও তাই, মানুষ। স্টিভেন স্পিলবার্গও সেই মানুষই। ভুল ঠিক সব মিলিয়েই আমরা মানুষ।
শত্রুপক্ষের গুপ্তচরের হয়ে মামলা লড়ছে, এরকম লোককে সমাজ মোটেই ভাল চোখে দেখেনা। অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকবাজ ডনোভানের বাড়িতে গুলি চালিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। সেই ঘটনার তদন্তে এসে উর্দিধারী পুলিস ডনোভানের ভূমিকায় উষ্মা প্রকাশ করে। তবে সব কিছুর ওপরে রাখবো ট্রেনের ওই ভদ্রিমহিলার চাউনি কে। সকালের ট্রেনে অফিস যাবার সময় কাগজে ডনোভানের ছবি দেখে ট্রেনের সহযাত্রিরা ডনোভানকে চিনে ফেলে। এক মধ্যবয়সি মহিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন ডনোভানের দিকে। মুখে এবং ভ্রু-ভঙ্গিতে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়না। কিন্তু কি তীব্র ঘৃনা ঝরে পড়ছে চোখের মনি থেকে। জানিনা, ওই তাকানোটা ভদ্রমহিলাকে দিয়ে স্পিলুবাবু ঠিক কত বার, বা কতদিন ধরে অভ্যেস করিয়েছেন। নেহাত কয়েক মিনিটে এ বস্তু উৎরোয় না। প্রায় একই দৃশ্য আবার ফিরে এসেছে ছবির শেষে। তবে তার আবহ অন্য।সেখানে মহিলার চোখে ফুটে ওঠে খুব হালকা হাসি। আবহ বলতে মনে পড়ে গেল, এ ছবির চিত্রগ্রাহককে আমি আলাদা করে একটা সেলাম ঠুকবো। চলতি ধারনার সম্পূর্ন উলটো হেঁটে ভদ্রলোক আলোর অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছেন। বেশীরভাগ জায়গাতেই, বিশেষ করে ছবির প্রথম দিকে, পর্দার একটা অংশ জুড়ে চোখ ধাঁধানো সাদা আলো ঢুকছে, আর তার আশেপাশে আধো অন্ধকার আবছায়ার একটা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। কেমন যেন, সব কিছু এত আলো সত্ত্বেও কিছুটা ধোঁয়াশায় ঢাকা। আমিস্টাড ছবিতে খানিকটা একই রকম আলোর ব্যবহার দেখেছিলাম।
পরিবেশ তৈরি হয়েছে নিখুঁত দক্ষতায়। ১৯৫৭ সালের নিউইয়র্ক শহরের ফুটপাথে ডাঁই করা কাঠের বাক্স, ভাঙা ফুটপাথ, এলোমেলো নোংরা ছড়ানো, রাস্তায় জল জমা। ছেঁড়া বিজ্ঞাপন, জানলায় দড়ি টাঙিয়ে আটপৌরে জামা কাপড় শুকোনো, ঘুপচি সিঁড়ি, সরু সরু রাস্তা আর লাল ইঁট বার করা বাড়িতে হাজার হাজার কিলোমিটার দুরের নিউইয়র্ক কেমন যেন চেনা চেনা লাগে। বরফে ঢাকা বার্লিন দেখে চমক লাগে। বার্লিন প্রাচীর তৈরির সময়টা ভারি সুন্দর ধরা পড়েছে। তবে বার্লিনে সোভিয়েত ট্যাংক নিয়ে একটু খটকা। যদিও এক ঝলক দেখা, তবুও মনে হলো যেন T-62 ট্যাংক দেখলাম। সময়কাল দেখানো হচ্ছে ১৯৬২। তার ঠিক এক বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন T-62 র উৎপাদন শুরু করে। অস্ত্র হিসেবে T-62 খুবই জটিল, দামী ও উন্নতমানের আর তাই এই সোভিয়েত ট্যাংক ছিল চরম গোপনীয়। উৎপাদন শুরু হবার এক বছরের মধ্যে, সেই গোপন অস্ত্রকে, তৈরি হতে থাকা বার্লিন প্রাচীর থেকে মাত্র কয়েকফুট দূরে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে, এটা তেমন বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। তেমনই, ডনোভান ট্রেনে বার্লিন প্রাচীরের ওপর দিয়ে যাবার সময়, পাঁচিল টপকে অন্য দিকে যাবার জন্যে কয়েকজন মানুষের দৌড়, আর পেছনে ফৌজি অবজার্ভেশন টাওয়ার থেকে তাদের গুলি করার দৃশ্য স্পিলবার্গের পরিমিতিবোধ এবং ছবির মেজাজের সঙ্গে ঠিক খাপ খায়নি বলেই আমার মনে হল। এটা এত সোজাসুজি দেখানোর হয়ত দরকার ছিলোনা। পূর্ব জার্মান সীমান্তরক্ষীদের হেলমেটগুলো বড় বেশী চকচকে। যদিও জার্মানরা বরাবর খুব নিখুঁত ও নিপাট থাকেন, তবুও দু একটা হেলমেট একটু রংচটা হলে বোধহয় খাপ খেতো পরিবেশের সঙ্গে। পেশাওয়ার বিমানবন্দরে, যেখান থেকে মার্কিন গুপ্তচর U2 বিমান উড়তে চলেছে, সেখানে একজনও পাকিস্তানি নেই। মিলিটারি এয়ারস্ট্রিপ হলেও অন্ততঃ এক আধজন পাকিস্তানি সান্ত্রির মুখ দেখা গেলে একটু বাস্তবসন্মত হতে পারত।
এই ছবির বড় সম্পদ ছবির সংলাপ। স্পিলবার্গের সঙ্গে সত্যজিত রায়ের এই সংলাপের ক্ষেত্রে মিল আছে। খুব কঠিন সময়েও চরিত্রের মুখে এমন কিছু সংলাপ তাঁরা দুজনেই বসাতে পারেন, যাতে করে, ছবির টান টান উত্তেজনা ও মেজাজ নষ্ট না করেও রসবোধের চুড়ান্ত একটা ব্যাপার তৈরি করে দেয়। স্পিলবার্গ আর সত্যজিতের ছবির চরিত্রেরা মানুষের ওপর, তার মানবিকতার ওপর বিশ্বাস হারাতে দেয়না। টানটান উত্তেজনার মুহুর্তে এরকম রসিক মন্তব্য তারই প্রকাশ। উদাহরন দিই – লুকিয়ে রাখা ধনরত্নের খোঁজে শিশু অপহরনকারী দুই কুখ্যাত খুনি অপরাধীর পিছু নিয়েছেন গোয়েন্দা। গুপ্তধনের খোঁজ পেয়ে গেলে তারা শিশুটিকেও মেরে ফেলবে হয়ত। প্রতিটি মুহুর্ত টানটান। মরুভূমির মধ্যে ছুটে চলতে চলতে আচমকা প্রশ্ন ভেসে আছে উটের খাদ্য নিয়ে। উটের খাদ্য কাঁটা গাছ নিয়ে। কাঁটা কি তারা বেছে খায়? স্পিলবার্গের এই ছবিতে রুডলফ আবেলকে, উকিল ডনোভান বোঝাতে থাকেন, তিনি আবেলের পক্ষে মামলা লড়বেন। আর আবেল যেন কোনো অবস্থাতেই ডনোভান ছাড়া আর কারোর কাছে মুখ না খোলেন। কেননা বাকি গোটা আমেরিকা প্রানপন চেষ্টা চালাচ্ছে আবেলকে যাতে ইলেকট্রিক চেয়ারে চড়ানো হয়। এ কথা শুনে আপাত নিরীহ, রোগাভোগা বুড়োটে আবেলের কোনো ভাবান্তর হয়না। অবিচলিত এবং ধীর লয়ে আবেল উত্তর দেন – “All right”। এই উত্তর শুনে ডনোভান আশ্চর্য্য হয়ে যান – “You don’t seem to be alarmed”। একই রকম অবিচলিত স্লথ স্বরে আবেল পালটা প্রশ্ন করেন – “Well……..would it help?”। ছবিতে যে দুটো সংলাপের জায়গায় আমি নড়ে গেছি, তার মধ্যে এটা একটা। এত সাধারন একটা লোক, এত সামান্য সংলাপ তার মুখে । কিন্তু সে শুধু যে এক মহাশক্তিধর দেশের গুপ্তচরই নয়, তার পেছনে আছে গোটা জীবন দিয়ে অনুশীলন আর অনুধাবন করা এক আদর্শবাদে পুষ্ট মানসিক শক্তি। মানুষটা যে কি ধাতুতে তৈরি, এখানে সেটা আর একবার প্রমান করে দেন স্পিলবার্গ। কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে ওই ছোট্ট প্রশ্নের মধ্যে ফুটে ওঠে রসবোধ। মনে মধ্যে কোথাও, আর এ্কজন সাদামাটা টাক মাথা লোক, রুডলফ আবেল কে লক্ষ্য করে বলে ওঠেন – “রসিক লোক মশাই আপনি!”।
চরিত্রের ভেতর গভীরতা আনতে একদিকে যেমন রসবোধের ব্যবহার, অন্যদিকে আবার রুডলফ আবেল খুব সামান্য সময়ের জন্যে খোলস ছেড়েও বেরিয়ে আসেন। অবশ্য, তাতে সৌজন্যতাবোধ এতটুকু মার খায় না। রুডলফ আবেল একজন ওস্তাদ চিত্রকর। বন্দি অবস্থায় তিনি তাঁর উকিল ডনোভানকে অনুরোধ করেন, যদি কিছু কাগজ আর পেনসিল পাওয়া যায় ছবি আঁকার জন্যে। ডনোভান স্পষ্ট জানিয়েদেন বিচারাধীন বন্দিকে এসব দেওয়া সম্ভব নয়। খুব শান্ত ভঙ্গিতে আবেল ডনোভানকে জানান, যে তিনি নিশ্চিত, আবেলের মত কিছু গুপ্তচর, আমেরিকার হয়ে সোভিয়েত দেশে চরবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে, এবং তারা যে কোনো সময় ধরাও পড়তে পারে। আমেরিকান সরকারের খেয়াল রাখা উচিত, ধরাপড়ার পর সেই মানুষগুলো যেন সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের কাছে ভাল ব্যবহার পায়। সোজা কথায়, প্রচ্ছন্ন হুমকি। ভাল লেগেছে আবেলের কথা বলার ভঙ্গী। ইতিহাস বলছে আবেলের জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর ইংল্যান্ডে। তাঁর কথাবলার ভঙ্গিও সেই অঞ্চলের। তবে সামান্য এক দু জায়গায় মনে হয়েছে একটু যেন স্কটিস ঘেঁষা উচ্চারন। আশ্চর্্য্য আবেগহীন এই চরিত্রই, তাঁর উকিলের ওপর হামলার আশঙ্কায় বলে ওঠেন – “Jim…………….careful”। তার পর একটু থেমে ফের বলে ওঠেন “careful”। এই ভঙ্গিগুলো অনবদ্য লেগেছে।
ডনোভানের চরিত্রে স্পিলবার্গের সবচেয়ে বেশী ছবির নায়ক, টম হ্যাঙ্কস। টম কেমন অভিনয় করেন, এবং চরিত্রায়নে তাঁর ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করার ধৃষ্টতা আমি দেখাবোনা। কিছু কথা বলতে পারি এই ছবিতে জেমস ডনোভানের চরিত্র নিয়ে। জেমস ডনোভান একজন আমেরিকান উকিল, যিনি বিমা সংক্রান্ত ব্যাপারের মামলা মোকদ্দমা লড়েন। স্পিলবার্গ এবং টম হ্যাঙ্কস এরকম একটা কাটখোট্টা চরিত্রে কিছু বিরল মুহুর্ত উপহার দিয়েছেন প্রবল ঝুঁকি নিয়ে। যদি একেবারেই কাটখোট্টা হিসেবে দেখানো হয় ডনোভানকে, তাহলে চরিত্রটি আকর্ষন হারায়, আবার অন্যদিকে যদি আবেগ ও মানবিকতা সামান্য পরিমানেও মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা, বাস্তবতা নষ্ট হয়ে যায়। খুব সরু একটা জায়গা দিয়ে হাঁটতে হয়েছে দুজনকে্ এবং দুজনেই সেটা চরম দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। ডনোভান মামলা হাতে নেন খুব বেশী প্রত্যাশা ছাড়াই। তিনি হাসতে হাসতেই বলেন - লোকে আমাকে ঘেন্নাও করবে, আবার আমি মামলায় হেরেও যাবো, এটাই সব চেয়ে বেশী কিছু প্রাপ্তি। অর্থাৎ এর চেয়েও খারাপ কিছু হতে পারে। প্রথমে ডনোভান এক্কেবারে খাঁটি পেশাদার উকিলের মত নিজের পরিচয় দিয়ে আবেলের কাছে জানতে চান যে আবেল তাঁকে মামলা লড়ার অনুমতি দেবেন কিনা। আবেল জিজ্ঞেস করেন, যে ডনোভান এর আগে কতজন অভিযুক্ত হওয়া গুপ্তচরের পক্ষে মামলা লড়েছেন। ডনোভান স্বীকার করেনেন, যে দুজনের ক্ষেত্রেই এই এই পরিস্থিতি প্রথম। আবেল হেসে ফেলেন, বুঝতে পারেন ডনোভানের এরকম মামলার অভিজ্ঞতা তেমন নেই। তবুও আবেল রাজি হয়ে যান। ডনোভান বোঝেন, আবেলকে সকলেই ইলেক্ট্রিক চেয়ার বা ফাঁসিকাটে দেখতে চায়। কিন্তু নেহাত কাজ চালানোর মত নয়, ডনোভান মামলায় খুব বেশী করে জড়িয়ে পড়তে থাকেন, হয়ত পেশাদার হিসেবে তাঁর কাছে যা আশা করা হয়, তার চেয়ে একটু বেশী করেই।
বিচার ব্যবস্থা বললেই আমাদের চোখের সামনে ন্যায়ের দেবীর ছবি ভেসে ওঠে, যাঁর চোখে ফেট্টি বাঁধা, আর এক হাতে দাঁড়িপাল্লা। “অন্ধা-কানুন”। কিন্তু আপাতনিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার মানবিক প্রভাব ও পক্ষপাতিত্ব নিশ্চিত ভাবেই রয়েছে। মামলা যাঁর এজলাসে, সেই জজ মর্টিমার বায়ার্স নিরপেক্ষ হতে পারছেন না। তাঁর চোখে নিশ্চিত ভাবেই আবেল একজন ধুর্ত গুপ্তচর এবং তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া উচিত। বিভিন্ন সময়ে ডনোভানের সওয়ালকে জজ সাহেব নস্যাৎ করেন। জুরিদের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হবার পর ডনোভান আর কোনো উপায় না দেখে জজ সাহেবের বাড়ি চলে যান। শেষবারের মত বোঝাতে চেষ্টা করেন, ভবিষ্যতে কোনো আমেরিকান চরকে যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকড়াও করে, তাহলে দরকষাকষি ও বিনিময়ের জন্যে হলেও আবেলকে জীবিত রাখা প্রয়োজন। জজ সাহেব কিছুই নিশ্চিত করেন না, তবে রায় বেরোনোর সময় দেখা যায়, আবেলের মৃত্যুদন্ড হয়নি, ৩০ বছরের কারাবাসের সাজা হয়েছে। ডনোভান স্থির করেন তিনি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করবেন যাতে আবেলের শাস্তি কম হয়। এতেকরে ডনোভানের সুভানুধ্যায়ি, অফিসের লোকজন, পরিবার সকলেই ডনোভানের ওপর বিরক্ত হয়।
ছবির গল্পে যাবোনা। তাহলে পাঠক হয়ত ছবি দেখার উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। আমি চাই, এই লেখা পড়ে পাঠক যেন ছবিটা দেখতে উৎসাহবোধ করেন। ডনোভানের পরিবারের চিত্রন এক্কেবারে নিখুঁত। এমনকি ডনোভানের সহকারী তরুনের সঙ্গে ডনোভানের বড় মেয়ে ক্যারলের বিশেষ সম্পর্ক বড় সুন্দর ভাবে দেখানো হয়েছে। বিশেষ করে, রাত্রে খাবার টেবিলে বসে, বাইরে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ডিনারে না যেতে পারা, এবং পরমুহুর্তেই বাবার সহকারীকে (ইনিই সেই বয়ফ্রেন্ড) এক গাদা কাজের ফাইল ও বই সমেত বাড়িতে ঢুকতে দেখে ক্যারল ডনোভানের মুখের ভাব অনবদ্য। ক্যারলের ভুমিকায় অভিনেত্রী ইভ হিউসন কে ১০ এ ১০ দেবো। কোথাও এতটুকু বাহুল্য নেই। কোথাও এই সম্পর্ক নিয়ে একটা কথাও বলা হয়নি। কিন্তু নিখুঁত অভিনয় ও পরিচালকের মুন্সিয়ানায় সম্পর্কটা পরিস্কার ভেসে ওঠে। ডনোভানের চরিত্রে যে বস্তু আমাকে ক্রমাগত আকর্ষন করে গেছে, সেটা হলো সব কিছু ছাপিয়ে, একজন নেহাতই ছাপোষা পারিবারিক মানুষ হিসেবে থেকে যাওয়া। যিনি গুরুত্বপূর্ন কাজের মধ্যেও গিন্নির ফরমাসের মার্মালেডের শিশি আনতে ভোলেন না। যদিও লন্ডন থেকে আনার বদলে, তিনি সেটা এনেছেন পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে। একেবারে শেষে এসে, অনেক ধকল, অনেক মানসিক চাপ ও টানাপোড়েন কাটিয়ে, অনেক দুরত্ব পেরিয়ে বাড়িতে এসে নিজের শোবার ঘরের বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে ডনোভানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়াটা বড্ড ভাল লেগেছে।
ছবিতে ডনোভান বারবার নিজের অবস্থান পরিস্কার করেছেন। কখনো রুডলফ আবেলের কাছে, যেখানে তিনি জোর দিয়ে বলছেন, তিনি মার্কিন সরকারের হয়ে কাজ করেন না। কখনো সিআইএ এজেন্ট কে বলেছেন, তাঁর থেকে মার্কিন সরকারের ভয়ের কোনো কারন নেই, যতক্ষন তাঁকে নিজের ইচ্ছেমত কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে। যখন এজেন্ট তাঁকে বোঝাতে এসেছেন, যে এই ঠান্ডা যুদ্ধের কোনো নিয়ম নেই, ডনোভান এজেন্ট হফম্যানকে দেখিয়েছেন – হফম্যান জার্মান বংশদ্ভুত, ডনোভান আইরিস, তাহলে তাঁরা দুজন আমেরিকান হলেন কি ভাবে? ডনোভানের যুক্তি, তাঁরা আমেরিকান কারন তাঁরা দুজনেই আমেরিকার সংবিধান মানেন। কাজেই রুলবুক তো আছেই। সেটা ছাড়া হয়না। যেটা অনুচ্চারিত, সেটা হল, অন্যদিকেও যাঁরা আছেন, তাঁদেরও যে রুলবুক আছে, সেই বিশ্বাসটা ডনোভানের রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে ডনোভান সওয়াল করছেন, মুখ্য বিচারপতিকে বোঝাচ্ছেন – এই যুদ্ধ শুধু দুটো দেশের অস্ত্রের নয়, যুদ্ধ দুই দৃষ্টিভঙ্গির, দুই আদর্শবাদের। কর্নেল আবেল এই যুদ্ধে আমেরিকার শত্রুপক্ষের লোক। মার্কিন সরকার আবেলকে, একজন মার্কিন নাগরিকের যা যা সুযোগ দেওয়া উচিত, তা দেননি। তবে একজন শত্রুর যতখানি সুযোগ সুবিধে পাওয়া উচিত, তার সবটুকুই আবেলকে দেওয়া হয়েছে। যদি যুদ্ধ বলে ধরি বর্তমান অবস্থাকে, তাহলে রুডলফ আবেল একজন সৈনিক। শত্রুপক্ষের সৈনিক। এবং একজন ভাল সৈনিক, যিনি লড়াই ছেড়ে পালাননি। নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে তিনি ব্যক্তিগত সুবিধে ও নিরাপত্তার জন্যে মার্কিন সরকারের সঙ্গে সহযোগীতায় রাজি হননি। একজন কাপুরুষ, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাবার আগে আত্মসন্মান বিসর্জন দেবেন। রুডলফ আবেল পালাননি। নিজের আত্মসন্মান বজায় রেখে গেছেন। আমাদের কি উচিত নয়, এই সৈনিককে মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে একজন নাগরিকের যা যা সুযোগ সুবিধে পাওয়ার তা দেওয়া? আমরা আসলে কেমন, দুনিয়াকে সেটা দেখিয়ে দেওয়ার কি এই সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত? এই ঠান্ডা যুদ্ধে, আমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র কি “আমরা আসলে কে” সেইটা নয়? বার বার ডনোভানের চরিত্রে যে দিকটা ফুটে বেরিয়েছে, সেটা শুধু ডনোভানের নয়, আমাদের সমাজের মানবিক মুখ।
দর্শককে এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যে যাওয়া ব্যাপারটা বেশ কঠিন একজন পরিচালকের কাছে। অনেক ভেবেচিন্তে খেলতে হয়। একটু এদিক ওদিক হলেই খেই হারিয়ে যেতে পারে। সাধারনতঃ নামকরা পরিচালকরা এটা করে থাকেন সসাবধানে এবং অনেক কিছু মেপে। স্পিলবার্গকে এই ছবিতে দৃশ্যান্তর দিয়ে অদ্ভুত কিছু সিনেমাটিক মুহুর্ত তৈরি করতে দেখলাম। আদালতে বিচারক ঢোকার মুহুর্তে সবাইকে উঠে দাঁড়াতে বলে “All Rise” ঘোষনা করা হয়, ঠিক সেই মুহুর্তেই দৃশ্য বদলে চলে যায় ডনোভানের ৯-১০ বছরের ছেলের স্কুলে, যেখানে স্কুলের ছাত্রছাত্রিরা উঠে দাঁড়ায় এবং জাতীয় পতাকার সামনে প্রার্থনা সঙ্গীতের ঢং এ আমেরিকান Pledge of Allegiance বলতে থাকে - “I pledge allegiance to the Flag of the United States of America, and to the Republic for which it stands, one Nation under God, indivisible, with liberty and justice for all”। শিশুকাল থেকে পাখিপড়ার মত ঢুকিয়ে দেওয়া মাথায়। আমেরিকান ফ্ল্যাগ স্বাধীনতা এবং সুবিচার নিয়ে আসে। ঠিক তার আগের দৃশ্যে জজসাহেব ডনোভানকে নিজের ঘরে ডেকে বলেছেন, তাঁর এবং বিচার ব্যবস্থার প্রথম আনুগত্য আমেরিকান সংবিধানের প্রতি। তার পর বাকি সব। এই বলে তিনি ডনোভানের দাবী নস্যাৎ করেছেন। কি অদ্ভুত সাহসীকতা। জজের মাথায়ও শিশুকালেই গেঁথে গেছে যে ধারনা, তার পর তাঁর কাছে বিচার ব্যবস্থায় চুলচেরা নিরপেক্ষতা আশা করা যায় কি?
সুপ্রিম্ কোর্টে দাঁড়িয়ে ডনোভানের সওয়ালের মাঝে মাঝেই দৃশ্যান্তরে গিয়ে পাকিস্তানের পেশাওয়ার বিমানবন্দর থেকে মার্কিন গুপ্তচর U2 বিমান নিয়ে পাইলট গ্যারি পাওয়ার্সের ওড়ার টুকরো টুকরো দৃশ্য এসেছে। কোলাজের মত এই টুকরো টুকরো দৃশ্যান্তর গল্প বলার একটা সুন্দর আবহ তৈরি করেছে। ছবিতে গ্যারি পাওয়ার্সের চরিত্রটা দুর্বল লেগেছে। বিমানবাহিনির লেফটেন্যান্ট এত ক্যাবলা হয় কেন? স্পিলবার্গ মনে হয় এই চরিত্রটার পেছনে ভালকরে সময় দেননি। অথচ তার চেয়ে ঢের ছোটো চরিত্রে পূর্ব জার্মান উকিল মিস্টার ভোগেল এবং আরো কম সময়ে পর্দায় থাকা পূর্ব জার্মান অ্যাটর্নী জেনারেল হর্ট অনেক বেশী উজ্জ্বল। হর্টের স্টেনো ছোকরা, যে ভাল ইংরিজি জানে, এবং যার মাধ্যমে ডনোভান হর্টকে তাঁর শেষ মেসেজ পাঠান, কেন জানি সেই ছোকরার অভিনয়টা চোখে লেগে আছে। এরকম ছোটো দৃশ্যে আর এত কম সংলাপে তার কিছুই করার ছিলোনা হয়ত। কিন্তু ওই যে, পটলবাবু একটা “আঃ” দিয়েই বাজিমাত করে দিতে পারেন, সেরকম এই ছোকরাও একটা বোকাসোকা চাউনি আর হাসি দিয়ে বাজি মেরে দিয়ে গেল। তবে ছবির পার্শ্বচরিত্রের মধ্যে সবচেয়ে দাগ কাটে সোভিয়েত দুতাবাসের কর্মী ইভান শিষকিন। পরে অবশ্য সিআইএর লোকজন ডনোভানকে বলেন শিষকিন আসলে নাকি কেজিবির লোক। দুতাবাসের কুটনীতিজ্ঞদের ফ্রেমে বাঁধানো সৌজন্যতা শিষকিনের ব্যবহারে। নিজের পক্ষের যুক্তি ও সুবিধে বুঝে নিতে তিনি ওস্তাদ। সব কিছুতেই নিয়মের বেড়াজালে অন্য কুটনীতিকের মতই তিনি বন্দী। তবুও কোথাও যেন তিনি ওপক্ষের ডনোভান। কোথায় যেন কুটনীতিজ্ঞের লৌহকঠিন বর্মের আড়ালে মানবিক আবেদন তাঁর মধ্যে রয়ে গেছে। সব কিছুর পর যিনি ডনোভানকে বলেন এই ঠান্ডায় ওভারকোট পরে বেরোতে, বা ঠান্ডা লাগার দাওয়াই হিসেবে আর্মেনিয়ান ব্র্যান্ডি খাওয়ান। পর্দায় ছোট্ট উপস্থিতি। কিন্তু শিষকিন মনে থেকে যান অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত, গভীর ও শান্ত চাউনির জন্যেও। অভিনেতা মিখাইল গোরেভয়কে এর আগেও দেখেছি জেমস বন্ডের ছবিতে। এ ছবি আর সে ছবির শিষকিনের ভুমিকায় মিখাইল গোরেভয়কে মেলানো যায়না কিছুতেই। হয়ত এটাই কল্পনার গুপ্তচর আর আসল গুপ্তচরের মধ্যে তফাত।
রুডলফ আবেলের শৈশবে তাঁদের বাড়িতে একজন লোক আসত। আবেলের বাবা বলতেন, এই লোকটিকে ভাল দেখে দেখে রাখো। সে লোকটা কখনো এমন কিছু করেনি যার জন্যে তাকে মনে রাখা যায়। জেলে বন্দী অবস্থায় আবেলের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন ডনোভান। আবেল তখন ডনোভানকে এই লোকটি সম্পর্কে বলতে শুরু করেন। সবার কাছে নিন্দে কুড়িয়ে, মামলা হেরে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়ে আবেলের ৩০ বছরের কারাবাসের সাজা হবার পর ডনোভান তখন আবার সকলের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করবেন বলে ঠিক করেছেন। আবেলের মুখে এই গল্প শুনে ডনোভান বলেন – আমাকে দেখে কি এই লোকটার কথা মনে পড়ল? আবেল সে কথার উত্তর না দিয়ে বলে চলেন, একবার কিছু সীমান্তরক্ষী তাঁদের বাড়িতে এসে তাঁদের মারধোর শুরু করেছিল। সবাই মার খেয়েছিলো। আবেলের বাবা, মা। এমনকি ওই লোকটাও। কিন্তু যতবার সে মার খায়, পড়ে যায়, ততবার সে উঠে দাঁড়ায়। শেষে বার বার উঠে দাঁড়াতে দেখে বিরক্ত হয়ে সীমান্তরক্ষীরা লোকটাকে মারাই বন্ধ করে দিলো। “স্তোইকে মুঝিক, ওরা বলল। ইংরেজিতে বললে খুব কাছাকাছি অর্থ দাঁড়াবে – Standing Man”। ছবিতে এই Standing Man আবার ফিরে এসেছে একেবারে শেষে।
গ্যারি পাওয়ার্স এবং রুডলফ আবেলকে বিনিময় করা হবে বার্লিনের গ্লেইনকে সেতুর ওপর। যে সেতুর একদিকে পূর্ব বার্লিন, অন্যদিকে পশ্চিম বার্লিন। এর আগে দু পক্ষে অনেক দরকষাকষি, কূতনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা চলতে থাকে। এর মধ্যে ফ্রেডরিক প্রায়র বলে এক আমেরিকান ছাত্রকে পূর্ব জার্মান পুলিস আটক করে। সে বেচারা নেহাতই ছাত্র। রাজনীতির সঙ্গে কোনো যোগ নেই। এক অধ্যাপকের মেয়ের সঙ্গে তার একটি ইয়ে মত হয়েছিল। সে অধ্যাপকের বাড়ি আবার পূবে। সেই উপলক্ষে পূবে গিয়ে ছোকরা ফেঁসে যায়। ডনোভান দাবী করেন যে ফ্রেডরিক প্রায়রকেও যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। সিআইএ বলে তারা ফ্রেডরিক ছোকরার ব্যাপারে একেবারেই উৎসাহী নয়, কারন সে গুপ্তচর নয়। কিন্তু জিম ডনোভান ঠিক করেন তাঁর গ্যারি পাওয়ার্সের সঙ্গে তিনি প্রায়রকেও মুক্ত করবেন। অনেক টানাপোড়েন কাটিয়ে শেষে ঠিক হয় ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় গ্লেইনকে সেতুর ওপর আবেল ও পাওয়ার্সের বিনিময় হবে। ঠিক সেই সময়েই বার্লিনের আর এক সীমান্ত পোস্ট, চেকপয়েন্ট চার্লিতে পূর্ব জার্মান পুলিস ফ্রেডরিক প্রায়রকে ছেড়ে দেবে। গ্লেইনকে সেতুর ওপর যথা সময় আমেরিকান ও সোভিয়েত পক্ষ তাদের বন্দীদের নিয়ে উপস্থিত হয়। ডনোভানকে দেখে আবেল যাহারপরনাই খুশী হন। ওপাশে গ্যারি পাওয়ার্সকে নিয়ে শিষকিনও উপস্থিত। ডনোভান খবর নিতে বলেন, চেকপয়েন্ট চার্লিতে প্রায়রকে পূর্ব জার্মান পুলিস মুক্তি দিতে এসেছে কিনা। কেউ আসেনা। বার বার খবর নেওয়া হতে থাকে।
এদিকে সিআইএ এজেন্ট হফম্যান চাপ দিতে থাকেন, যে আবেল্ যেন এগিয়ে যান ওদিকে। বিনিময় শুরু হোক। কিন্তু ডনোভান বলেন, প্রায়রকে মুক্তি না দিলে, তাঁরা এগোবেন না। “They are waiting to see if we could do without him. We just have to stand here and show that we won’t”। ডনোভান ও হফম্যানের কথা কাটাকাটি শুরু হয়। ওদিকে সোভিয়েত পক্ষও তাড়া দিতে থাকে। আবেল জিজ্ঞেস করেন, ডনোভান আরো কারোর মুক্তি চান কিনা। ডনোভান সংক্ষেপে বলেন ফ্রেডরিক প্রায়রের ব্যাপারটা। আবেল মুচকি হেসে ডনোভানের দিকে তাকিয়ে বলেন “স্তোইকে মুঝিক , Standing Man”। তার পর একটু গম্ভীর হয়ে, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, হতভম্ভ হফম্যানকে বলেন – “I can wait”। দুটো একবগগা লোক আর তাদের ছবি Bridge of Spies। ডনোভান আর আবেল। গ্লেইনকে সেতু ব্রিজ অফ স্পাইজ তো বটেই। কিন্তু এই স্পাইগিরি দিয়ে দু দেশের কিছু মানুষের মধ্যে মানবিক সম্পর্কও তৈরি হয়। সেতু তৈরি হয় - Bridge of Spies ।ছবিটা ফস্কাবেন না।