Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

সভাপতি সংবিক্ষণ



সভাপতি সংবিক্ষণ
স ম আজাদ

 স্যার, পবন ভাতা দিতে দিতে শেষ হইয়া গেলাম।
‘সেইটা আবার কি জিনিষ?’
‘বুঝলেন না স্যার, আমাগোর সভাপতি স্যারে কলেজের নামে জমি নিয়া  দরকারের থাইকা বেশী কইরা মানুষ নিয়োগ দিছিল। সরকারের কাছ থাইকা যখন ওর বেতন আইলো, তহন দেহা গেল চতুর্থ শ্রেণীর আমাগোরে চার জনের বেতন আইলো। আর পাঁচ জনের বেতন আইলো না। ঐ পাঁচ জনের চার জন নিরীহ। ওরা সভাপতিরে চাপ দেয় না। অনুনয় বিনয় করে জমি ফেরত পাইবার লাইগা। কিন্তুক, পবনের পাগলা পোলায় হুমকি দেয়, আমার বেতন আহে নাই ক্যা? হিসাব মতন তো আমার বেতন আহার কতা! সভাপতি স্যারে ওরে দেইখা ডরায়, অর ভাইয়ের অনেক জোর। তাই স্যার, আমাগোর চাইর জনের কাছ থাইকা টেহা নিয়া ওরে মাস মাস বেতন দেয়।’
কথাগুলো রহিমউদ্দিন অংক স্যারের কাছে বলে। রহিমউদ্দিন কলেজ শুরুর পর থেকেই আছে। ওর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিটা সে কলেজের নামে লিখে দিয়েছে। সে আট বছর টানা কাজ করছে কোন বেতন পায়নি। কিন্তু হাদিসে আছে শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগেই তার মজুরি দিতে হবে। কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা কি আগুনের তৈরী, তাদের ক্ষুধা লাগেনা? এমপিও ভুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কলেজ থেকে কোন বেতন পায়নি অন্যান্য শিক্ষকেরা। কিন্তু ঠিকই বেতনের লেজার বইতে সিগনেচার করেছে। অডিটে সব কাগজপত্র ঠিক ঠিক দেখানো চাই। কাজেই বেতন না পেয়েই সবাই সাইন করে দেয়।  বেতনের এতগুলো টাকার দাতা কে? লেজারে উঠে গেল সভাপতির ছেলের নাম দাতা হিসেবে।
সভাপতির ক্ষমতা অনেক। আমেরিকার সংবিধানে প্রসিডেন্টকে এত ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তিনি গভর্নিং বডির সভা না ডেকেই কাগজে-কলমে সভা দেখানে পারেন। সেই সভার রেজুলেশন তিনি ইচ্ছেমত লিখেন। এমন কি ডিসি সাহেবও না পড়ে তাতে সাইন দেন। সভাপতির অংক স্যারের উপর মেলা রাগ। এই দুই পয়সার মাস্টার দেখতে আউলা-বাউলা, ভিতু। মনে হয়েছিল গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি বানালে সভাপতি যা বলবে তাই শুনবে। প্রথম প্রথম সভাপতিকে সঙ্গ দিত, তার অতীত অভিজ্ঞতার কাহিনী মনোযোগ দিয়ে শুনতো। ভাবতো সত্যিই বুঝি গ্রেট ম্যান। একরকম জোর করেইতো নিয়োগ দিয়েছিল। তিনি বলতেন, ‘আপনার প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের শিক্ষার অভিজ্ঞতা গ্রাম বাংলার দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের দরকার। প্রফেসর সাহেব, আপনি থাকেন। দুই-তিন বছরের মধ্যে বেতন হয়ে যাবে, বেশী দিন কষ্ট করতে হবে না।’
অংক স্যারের অবাক অভিজ্ঞতা হতে থাকে। একদিন বোর্ডের ইন্সপেক্টর আসেন। সঙ্গে উচ্চপদস্হ ও নিম্নপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা, একজন আবার হাজি সাহেব। অ্যাফিলিয়েশনের জন্য তদন্ত। তদন্ত শেষে তাদের জন্য খানা-পিনার ইন্তেজাম। অবশেষে অ্যাফিলিয়েশন হল। বেতনের জন্য এমপিও ভূক্তির জন্য  ডিজি মন্ত্রণালয় দৌড়াদৌড়ি শুরু হল। কোথায় তদবিরের জন্য লোক পাওয়া যায়। এতো বাংলাদেশ, শিক্ষকের বেতন অধিকার নয়, উপরওয়ালার দয়া। শিক্ষা অধিকার নয়, পণ্য। চুক্তি হল লাখ টাকার উপর দেয়া লাগবে। চাঁদা তোলা হলো শিক্ষক প্রতি ছয় হাজার টাকা করে। এক শুক্রবারে গোসাইহাটি গ্রামে টাকার বান্ডিল নিয়ে গেলেন তিন শিক্ষক। জুমা বাদে  নুরানী চেহারার কেরাণী সাহেবকে বান্ডিল তুলে দেয়া হলো। আল্লাহর রোশনাই তার চেহারায়। তিন বললেন, ‘মুসলমানের জবানের কোন নড়চড় হয় না। আপনাগোর কাম অবশ্য হইবো। সারা জীবনইতো জেলাবাসীর উপকার করলাম। চাকরির আর বেশী দিন নাই। শীঘ্রই রিটায়ারমেন্টে আসবো। দোয়া কইরেন, মেহেদী সাবের পর আপনাগোরে এলাকায় সংসদ নির্বাচন করুম।’
গৃহস্থ ক্ষেতে মজুর নিয়োগ করলে অন্ততঃ হাটবার মজুরি পরিশোধ করে দেয়। হায়, বাংলাদেশের সমাজপতিরা, ঋণখেলাপীরা, অধঃপতিত রাজনীতিকরা বেতনের কোন ব্যবস্থা না করেই স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দানবীর সেজে যান। সামাজিক নিয়মে ঈদ পালা-পার্বণ আসে। শিক্ষক অসহায় বোধ করেন বউ ছেলে-মেয়ের সামনে। তিনি যে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিনা বেতনের শিক্ষক।
অবশেষে একদিন এমপিও আসে। কারো কারো এর জন্য চলে গেছে জীবনের প্রায় এক দশক। কিন্তু কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। সরকার থেকে কবে বরাদ্দ আসবে তার জন্য সভাপতির দেরী সয় না। শিক্ষকরাতো বেতন পেতে শুরু করেছে।  তার দিক দশ পারসেন্ট করে। গভর্নিং বডির সভায় রেজুলেশন হলো। আর তাদের বকেয়া বেতনের পুরোটাই কলেজকে দিতে হবে। রেজুলেশন সাইন সংগ্রহ শুরু হলো। অংক মাস্টারের সই দরকার। সভাপতি রেজুলেশন খাতা এগিয়ে দেন।
‘অংক স্যার, এইখানে সই দেন।’
‘রেজুলেশনতো পড়া দরকার, স্যার।’
‘রেজুলেশন পড়ার দরকার নাই। আমার রেজুলেশন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাহেব না পড়েই সই দেন। আপনি ভুল করলেন এই কথা কইয়া। আমি কিন্তু সভাপতি।’
অংক স্যার তো অবাক!

আজ থেকে আট বছর পূর্বে উপরের লেখাটি টাঙ্গাইলের ভুঞাপুর থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন 'পথ'-এর সংখ্যা ৫, বর্ষ ২, আশ্বিন-কার্তিক ইস্যুতে ছাপা হয়েছিল। লিখেছিলাম আরো আগে, তবে সঠিক সময় মনে নেই। এ লেখাটি ব্লগে দেয়ার উদ্দেশ্য হল পাঠকরা তখনকার সময়ের গ্রাম অঞ্চলের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিরাজমান নৈরাজ্যের একটি খন্ড চিত্র দেখতে পাবেন। কিছু ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকতেই পারে। তবে ব্যতিক্রম নিয়ম নয়। এখন অবস্থার উন্নতি হয়েছে এটা বলা যাবে না। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে অবনতি বৃদ্ধি পেয়েছে।

ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks