Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

দেশ ও শিক্ষা ~ সুশোভন পাত্র

আপনি আমিষাশী? মাছ-মাংস-ডিম খান? তাহলে প্রোটিনের জরুরী খাদ্যগুণে শরীর পুষ্ট হওয়া তো দূর, আপনার মিথ্যে বলার, লোক ঠকানোর, যৌন সুড়সুড়ি দেবার এমনকি মানুষ খুন করার প্রবণতাও বেশী -বলছে ক্লাস সিক্সের সি.বি.এস.সি'র টেক্সট বুক। মহারাষ্ট্রের বছর ১৪'র ছেলেমেয়েরা পড়ছে, 'হাউসওয়াইফ'রা গাধার মত। সারাদিন শুধু খেটে মরে। তবে একটু হলেও ভালো। অভাব অভিযোগ করে না, রাগ করে বাপের বাড়িও যায় না। ছত্তিসগড়ের 'সোশ্যাল সায়েন্স'র ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা শিখছে, দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণ মেয়েদের চাকরি করা। দিননাথ বাত্রার বইয়ে গুজরাটের স্কুল পড়ুয়ারা শুনছে, ড: রাধাকৃষ্ণন বলেছিলেন, ভগবান অজ্ঞনতা বশত প্রথমে যে কাঁচা রুটিটা উনুন থেকে বের করেছিলেন, সেটা থেকে জন্ম হয়েছিলো ব্রিটিশ'দের। অতি সাবধানতায় পরের পুড়িয়ে ফেলাটা থেকে জন্ম নিগ্রোদের, আর সবশেষে যেটা ঠিক সময়ে উনুন থেকে বেরিয়ে স্বাদে-গন্ধে-বর্ণে হল অতুলনীয়, সেটা আমরা, মানে 'ইন্ডিয়ান'রা। রাজস্থানের স্কুলে 'মহান সাধু-ঋষির' তালিকায় স্বামী বিবেকানন্দ, মাদার টেরেসা, গৌতম বুদ্ধ, গুরু নানকের পাশে সচিত্র সুশোভিত হচ্ছেন নাবালিকা ধর্ষণে অভিযুক্ত আশারাম বাপু।  
তবে এসবই কেতাদুরস্ত ইংলিশ মিডিয়ামের, ঝাঁ-চকচকে স্কুল বিল্ডিং'র চার দেওয়ালের রঙিন গল্প। দেশের সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থার হাঁড়ির হালটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট'ই। সর্বশেষ ASER'র রিপোর্টে দেশের ২১.৬% ক্লাস এইটের ছাত্রছাত্রী, ক্লাস টু'র টেক্সট বই'ই পড়তে পারে না। ১৫ বছরের ২৪.৫% স্কুলপড়ুয়ারা ১-১০ সংখ্যা চিনতে পারে না। ৫২.৫% ফাইভের ছাত্র সহজ ভাগের অঙ্ক কষতে পারে না। আর ৭৫.৫%, সামান্য বিয়োগ করতে পারে না।
ভারতবর্ষের প্রতিটি 'দায়িত্বশীল' সরকারই এই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি বদলাতে দেশবাসী কে রঙিন স্বপ্ন দেখিয়েছে। কমিশন বসেছে। মিটিং হয়েছে। সার্ভে করেছে। ভাষণে লাল কেল্লার রঙ্গমঞ্চ উপচে পড়েছে। কোঠারি কমিশনের রিপোর্টের কাঠখড় পুড়িয়ে, স্বাধীন ভারতের পার্লামেন্টে, ১৯৬৮'তে প্রথম ন্যাশনাল ইডুকেশন পলিসি পাশ করিয়ে, ইন্দিরা গান্ধী যেবার ১৪ বছর পর্যন্ত সকলের প্রাথমিক শিক্ষা সুনিশ্চিত করার গুরুদায়িত্বটা রাষ্ট্রের কাঁধে তুলে নিলেন, সেবার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলো পাটলিপুত্র থেকে লোনাভেলা, মগধ থেকে ক্যাওড়াতলা। লোক মুখে প্রচার হল, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে "শিক্ষা হবে সার্বজনীন"। তারপর গঙ্গা দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়ে, সোভিয়েতের পতন আর লগ্নী পুঁজির দাম্পত্যর মধুচন্দ্রিমার গর্ভজাত মুক্তবাজার অর্থনীতির ইনফ্যাচুয়েশেনের লুস-মোশেনে যখন ভেসে যাচ্ছে তাবড় সংবাদ মাধ্যমের দিস্তা-দিস্তা নিউজ প্রিন্ট, ঠিক তখন, ১৯৮৬-৯২'এ আমদানি হল দ্বিতীয় ন্যাশনাল ইডুকেশন পলিসি। প্রান্তিক মানুষের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার প্রকারান্তরে, বেসরকারি স্কুলে 'আর্থিক ভাবে দুর্বল' অংশের ২৫% সংরক্ষণের মাধ্যমে, শিক্ষা ক্ষেত্রে অভিষেক হল পি.পি.পি মডেলের। পরবর্তী সময় ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের চাপে আর 'লো-কস্ট পরিকাঠামো ও পরিষেবা' প্রদানের উদ্দেশ্যে 'প্যারা টিচারের' আমদানি এবং জনগণনা থেকে পোলিও, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ -দেশোদ্ধারের সমস্ত গুরু দায়িত্ব মাথায় চাপিয়ে দেওয়া স্থায়ী শিক্ষকদের নিয়োগের ব্যাপক ঘাটতিতে, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান যতই পড়েছে ছাত্রছাত্রী'দের মধ্যে ততই বেড়েছে স্কুল ছুটের আর বেসরকারি স্কুলে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রবণতা। শিক্ষা ক্ষেত্রেও লাক্ষণিক ভাবে প্রকট হয়েছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। NSSO'র ৭১তম সার্ভের তথ্যানুসারে উচ্চশিক্ষায় ভারতবর্ষের ধনীতম ৫%'র ন্যাশনাল এটেন্ডেন্স রেশিও যেখানে ৫৯.৫% , দরিদ্রতম ৫% 'র সেখানে মাত্র ২০.৫% । আর তার মাত্র ৬%, আদিবাসী, দলিত, সংখ্যালঘু, কিম্বা মহিলা। যেখানে ইউনেস্কো রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বের বৃহত্তম নিরক্ষরের বাস ভারতবর্ষে, সেখানে ২০২০'র মধ্যে ভারতবর্ষের ৫০% ছাত্রছাত্রী কে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের জন্যও নিজের ট্যাঁকের পয়সা খরচ করতে হবে বলে আশঙ্কা। শিক্ষা ব্যবস্থার উপর "কল্যাণকামী" রাষ্ট্রের 'সিস্টেমেটিক' বিমাতৃসুলভতার জন্যই স্বাধীনতার ৬৩ বছর পরও প্রয়োজন হয় RTE'র মত বজ্র আঁটুনির ফোস্কা গেরোর।
সদ্য অপসারিত সংসদীয় রাজনীতির শ্রেষ্ঠ 'মেলোড্রামাটিক' কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ৩০বছর পর আবার নতুন 'ন্যাশনাল ইডুকেশন পলিসি'র রণডঙ্কা বাজিয়েছেন। অবশ্য উনি তো সেই বিজেপি সরকারের প্রতিনিধি যারা প্রাথমিক শিক্ষাখাতে ১৩,৬৯৭ কোটি এবং উচ্চশিক্ষা খাতে ৩,৯০০ কোটি সরকারী বরাদ্দ হ্রাস করেছে। সেই 'আচ্ছে দিনের' সরকারে মন্ত্রী যারা ১৫%'র ছাড়া বাকিদের জন্য  ফেলোশিপ 'ডিসকন্টিনিউ' করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উনি সেই মুরলী মনোহর যোশীর যোগ্য উত্তরসূরি যিনি প্যারিসে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন "উচ্চশিক্ষা সমাজের কোন কাজেই লাগে না। তাই যার পয়সার জোর আছে সে পারলে পড়ুক।" উনি সেই ভারত সরকারে নিরবচ্ছিন্নতা যারা ২০০৫ 'ট্রেডেবেল কোমডিটি' হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থার অবারিত দ্বার WTO-GATS'র হাত ধরে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন বেসরকারিকরণের জন্য।বাজারে আজ 'শিক্ষা' বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। উচ্চশিক্ষার ৬৫%'ই আজ বেসরকারি। প্রাথমিক শিক্ষায় বিশ্বের গড় বেসরকারিকরণ যেখানে ১৪%, ভারতে সেখানে ২৫%। অ্যাসোচেমের তথ্যানুসারে, ভারতবর্ষের প্রতি বাবা-মা সঞ্চয়ের ৬৫% ব্যয় করতে বাধ্য হন সন্তানের শিক্ষা বা কেরিয়ারের পিছনে।
যে দেশে শিক্ষা এতো মহার্ঘ্য, যে দেশ জাতীয় আয়ের ৬% শিক্ষাখাতে খরচা করার ৫৮ বছরের পুরনো শর্ত এখনও পূরণে ব্যর্থ, যে দেশের হাইকোর্ট স্বাধীনতার প্রায় ৭০ বছর পর রায়দান করে বলে "সরকারও প্রশাসনের দুর্বলতা এবং ইন্ধনেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেড়েছে ধনী গরীবের বৈষম্য", যে দেশে মন্দির-মসজিদ-গির্জার মোট সংখ্যা স্কুল কলেজের থেকে ৯ লক্ষ বেশী, সে দেশের অঙ্গরাজ্যের টপারদের ত্রিভুজের চারটি বাহুর উপপাদ্য আবিস্কারই স্বাভাবিক, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সাথে রান্নার হেঁশেলের যোগসূত্র খোঁজাই ভবিতব্য, সে দেশের কপালে ইয়ালে ইউনিভার্সিটির ফেক ডিগ্রির কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী'ই নসীব, মুসলিম মৌলবি'দের সানিয়া মির্জার পোশাকের ফতোয়াই শিরোধার্য, সমাজবাদী পার্টির মন্ত্রীর শিশু ধর্ষণের জন্য মোবাইল কে দায়ী করাই কাম্য, সে দেশের তো রামদেবই ভগবান, জাকির নায়েকই মসীহা, সে দেশের গো-মূত্রই পানীয়, সে দেশের গোবরে সোনা খোঁজাই বিজ্ঞান...

ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks