Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

গান্ধী না গডসে ~ সুশোভন পাত্র

সেদিন একটু দেরিই হয়েছিল গান্ধীজীর। গোধূলির রাঙা আলো তখন ঝরে পড়ছে আগত অসংখ্য ভক্ত, অনুরাগী'দের গা বেয়ে। খালি পায়ে, ঘাসের চাদর বিছানো লনে গান্ধীজী কে আসতে দেখেই, তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে উদ্যত হন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। শীর্ণকায় গান্ধীজী'র সহকারী আভা চট্টোপাধ্যায় কে ধাক্কা দিয়ে, হঠাৎ সেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বদলে যায় ইটালিয়ান বেরেত্তা M1934, সেমি অটোমেটিক পিস্তলের তিনটে ৯MM বুলেটে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ ফায়ার। সরাসরি বুকে। স্থান, বিরলা হাউস, দিল্লী। কাল, ৩০শে জানুয়ারি, ১৯৪৮, বিকেল ৫:১৭। পাত্র, নাথুরাম গডসে।
রেডিও বার্তায় দেশবাসী কে গান্ধীজী'র মৃত্যু সংবাদ জানাতে গিয়ে নেহেরু যখন বলছেন "লাইট হ্যাস গন আউট অফ আওয়ার লাইভস",দেশের অগণিত মানুষ যখন ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল, গোটা বিশ্বের আপামর জনতা যখন ঘটনার বর্বরতায় শোকস্তব্ধ, তাবড় রাষ্ট্রনায়ক'দের সমবেদনার বেতার বার্তায় যখন ভেসে যাচ্ছে দিল্লী, তখন খুশির মিষ্টি বিতরণ হয়েছিলো আর.এস.এস আর হিন্দু মহাসভার দপ্তরে দপ্তরে। আগের পাঁচবার হত্যার চেষ্টার ব্যর্থতা ধুয়ে মুছে 'হিন্দুরাষ্ট্র' তৈরির পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলার সাফল্য উদযাপিত হয়েছিলো রীতিমত জান্তব উল্লাসে।
হিন্দু মহাসভার মারাঠি মুখপত্র হিন্দুরাষ্ট্র'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক পুনের চিতপাভন ব্রাহ্মণ নাথুরাম গডসে। ১৯৪৮'র ৮'ই নভেম্বর, গান্ধী হত্যার বিচারে, লালকেল্লার স্পেশাল কোর্টের ট্রায়ালে তিনি বলেছিলেন "সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে গান্ধীর ভণ্ড মুসলিম তোষণ ও হিন্দু'দের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ আমাকে এই কাজে বাধ্য করেছে।" কাশ্মীরে, পাকিস্তান হানাদার আক্রমণের পরেও, ভারত সরকার কে পাকিস্তানের ৫৫ কোটি টাকার ঋণ শোধে বাধ্য করে গান্ধীর আমরণ উপবাস এবং মুসলিম'দের আলাদা দেশ হিসেবে পাকিস্তান গঠনে গান্ধীর ভূমিকাই নাকি নাথুরামের সেই ঘৃণার বারুদের অগ্নিসংযোগে অনুঘটক হয়েছিলো। কিন্তু বাস্তবে, ইতিহাসের প্রামাণ্য সব নথিই নাথুরামের অভিযোগের ভিত্তিহীনতা'কেই প্রতিষ্ঠা করে।    
ধর্মীয় হানাহানিতে তখন রক্তাক্ত গোটা দেশ। 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসে'র পরও জ্বলছে বাংলা। পাঞ্জাব সীমান্তে পাকিস্তান ফেরত উদ্বাস্তু হিন্দু'দের রক্ত ঝরছে প্রতিদিন। খবর আসছে হানাহানির, ধর্ষণের। দিল্লীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় হিন্দুরা সেই হিসেব বুঝে নিচ্ছেন স্থানীয় মুসলমান'দের উপর। সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য ও সামাজিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে গান্ধীজী আমরণ অনশন শুরু করেন দিল্লীতে। ১৯৪৮'র ১২'ই জানুয়ারি সান্ধ্য প্রার্থনায় গান্ধীজী নিজে আমরণ অনশনের যেসব নির্দিষ্ট কারণ ব্যাখা করেছিলেন কিম্বা ১৭'ই জানুয়ারি গান্ধীজীর পক্ষ থেকে যে প্রেস বিবৃতি দেওয়া হয়েছিলো, কিম্বা সরকারের পক্ষ থেকেও ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ কমিটি গান্ধীজী কে আমরণ অনশন ত্যাগ করতে অনুরোধ করে যে সমস্ত শর্ত মেনে নেবার কথা বলেছিলেন –সেখানে কোথাও, নাথুরামের অভিযোগ মত, ভারত সরকার কে পাকিস্তানের ৫৫ কোটি টাকার ঋণ শোধের কথা উল্লেখ ছিল না। নাথুরামের কবিকল্পনা যাই হোক না কেন, দেশভাগে অত্যুৎসাহীও গান্ধীজী ছিলেন না। বরং ছিল হিন্দু মহাসভা আর মুসলিম লিগের মত উগ্র মৌলবাদী দলগুলি। ছিলেন নাথুরামের ধর্মগুরু, ব্রিটিশ'দের আনুগত্য স্বীকার করে মুচলেকা দেওয়া বীর সাভারকার আর জিন্না মত নেতারা। ১৯৩৭'র হিন্দু মহাসভার আহমেদাবাদে প্রকাশ্য অধিবেশনে সাভারকার বলেছিলেন "ইন্ডিয়া আর ঐক্যবদ্ধ ও সমজাতিক দেশ থাকতে পারে না। হিন্দু-মুসলমান আসলে তো দুটো আলাদা দেশই।" ১৯৪৫'এ এই সাভারকারই বলেছিলেন "টু-নেশন থিওরি তে জিন্নার সাথে আমার কোন দ্বিমতই নেই। হিন্দুরা নিজেরাই তো একটা দেশ।" কই নাথুরাম গডসে তো দেশভাগের সমর্থনকারী সাভারকারের বিরুদ্ধে বন্দুক ধরেননি? মুসলিম'দের আলাদা দেশ হিসেবে পাকিস্তান গঠনে নৈতিক সমর্থনের জন্য সাভারকারের বুকে বুলেট ভরে দেননি? বরং গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রের আপাদমস্তক অংশীদার ছিলেন সাভারকার। অভিযুক্ত'দেরই একজন দিগম্বর বাদগে ট্রায়াল কোর্টে তাঁর সাক্ষ্যতে বলেছিলেন "গান্ধী হত্যার তিনদিন আগে তিনি, নাথুরাম গডসে এবং নারায়ণ আপ্তে সাভারকারের সাথে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে দীর্ঘ মিটিং'র পর  তাঁদের বিদায় দেত্তয়ার সময় সাভারকার বলেছিলেন, যাও সফল হয়ে ফিরে এসো।" সাভারকারের মৃত্যুর পর তাঁর দেহরক্ষী আপ্তে রামচন্দ্র কেশর এবং সাভারকারের সেক্রেটারি গজানন বিষ্ণু দামলের স্বীকারোক্তি রেকর্ড করে কানপুর কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করে "অভিযুক্ত'দের প্রত্যেকেরই সাভারকারের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ঘনিষ্ঠতাও ছিল।"
গান্ধী হত্যার দায়ে ক্রোধোন্মত্ত দেশবাসীর ঘৃণার রোষানল এড়াতে লালকৃষ্ণ আদবানি  বলেছিলেন "আর.এস.এস'র সাথে নাথুরাম গডসের কোন সম্পর্কই নেই।" আদবানির মন্তব্য শুনে, ব্যঙ্গের হাসি হেসেছিলনে নাথুরাম গডসের ভাই গোপাল গডসে। বলেছিলেন "আদবানি কাপুরুষ। আমরা তিন ভাই'ই সঙ্ঘে ছিলাম। নাথুরাম ছিল 'বৌধিক কার্যবাহক'। পুলিশি বয়ানে নাথুরাম সঙ্ঘের কথা অস্বীকার করেন যাতে দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকার কোন আইনি বিপদে না পড়তে হয়। আমৃত্যু নাথুরাম সঙ্ঘেই ছিলেন।" এমনকি বর্তমান বিজেপি সরকার যে সর্দার প্যাটেলের ৫৯৭ ফুটের মূর্তি বসাচ্ছে, সেই সর্দার প্যাটেলও বিজেপির আদর্শগত অভিভাবক আর.এস.এস সম্পর্কে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি কে লিখেছিলেন "সরকার নিশ্চিত যে আর.এস.এস ও হিন্দু মহাসভার প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন মদতেই গান্ধীজীর হত্যার বীভৎসতা সম্ভব হয়েছে।"
এই চাপানউতোরেই  আজ বেঁচে আছেন গান্ধীজী। কখনও ২রা অক্টোবরের ড্রাইডে তে কখনও সর্দার প্যাটেলের চিঠিতে কখনও আবার রক্তভেজা ইতিহাসের পাতায়। গান্ধীজী আছেন, মানিব্যাগের নোটে, বাম-কংগ্রেস 'ধর্মনিরপেক্ষ' জোটে, স্বচ্ছ ভারতের বিজ্ঞাপনে, কিম্বা রাহুল গান্ধীর পদবির লেজুড়ে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী ভাষণে ভোটের অঙ্ক কষে গান্ধীজী কে 'মহাত্মা' বানাচ্ছেন, আর অন্যদিকে পার্লামেন্টে সাড়ম্বরে সাভারকারের মূর্তি স্থাপিত হচ্ছে। একদিকে সীমান্ত পেরিয়ে 'সার্জিক্যাল অপারেশনে' 'জঙ্গি এবং জঙ্গিদের সহায়তাকারী'দের' শায়েস্তা করে দেশোদ্ধার হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের ভেতরের 'জঙ্গি এবং জঙ্গিদের সহায়তাকারী'রা নাথুরাম গডস কে বীর শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। মিরাটে মন্দির বানিয়ে নিত্য পূজার আয়োজন করছেন। এই গান্ধী জয়ন্তী তে তাই আপনি ঠিক করুন এদেশে গান্ধী বাঁচবেন কিভাবে? গডসে'দের হাত ধরে না অহিংসা আর শান্তিতে? সেমি অটোমেটিক পিস্তলের বুলেটে না সত্যাগ্রহের অভ্যাসে? অসহযোগের প্রতিরোধে না ঘৃণার বারুদে? আপনি ঠিক করুন এদেশে বাঁচবে কে? গান্ধী না গডসে...

ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks