Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

জি এস টি ~ সুশোভন পাত্র

ঐ জোকসটা পড়েছেন? ঐ যে, ম্যাডাম তাঁর ছাত্র কে জিজ্ঞেস করছেন "বল ২ আর ২ যোগ করলে কত হয়?" অমনি ছাত্র নিঃসংকোচে উত্তর দিচ্ছে ৯.৫। উত্তর শুনে ম্যাডাম যখন ছাত্রের জ্ঞানের দীপ্ত বিচ্ছুরণে বিরক্ত হয়ে বেত্রাঘাতে উদ্যত, তখন সেই ছাত্র কাঁচুমাচু হয়ে হিসেব কষছে "২+২=৪ +VAT+সার্ভিস ট্যাক্স+হাইয়ার এডুকেশন সেস+স্বচ্ছ ভারত সেস+কৃষি কল্যাণ সেস+এক্সাইস ডিউটি করলে ওটা রাউন্ড ফিগারে ৯.৫'ই হবে।" ছাত্রের উত্তর শুনে সেই ম্যাডাম, সেই যে অজ্ঞান হয়েছিলেন, গত পরশুই তাঁর জ্ঞান ফিরেছে; মোট চারজন অর্থমন্ত্রী আর দুই সংসদের এক দশকের বায়নাক্কার পর জি.এস.টি সংক্রান্ত (১২২তম) সংবিধান সংশোধনী বিল রাজ্যসভায় পাশ হওয়াতে। মিডিয়ার করতালির লুজ মোশেনে প্রচার হয়েছে, আগের জটিল ও মিশ্র ট্যাক্সেশন পলিসির 'ক্যাসকেডিং এফেক্ট' সরিয়ে জি.এস.টি হবে অপেক্ষাকৃত মসৃণ ও নির্ঝঞ্ঝাট। বাঁকুড়ার চকবাজার থেকে কলকাতার লালবাজার, গৃহস্থের হাটবাজার থেকে বৌ'র শপিং'র পালিকাবাজার -এবার থেকে সব শেয়ালের এক রা, সব বাজারে এক ট্যাক্স। পণ্ডিতরা বলছেন ভীষণ ফেডারেল স্ট্রাকচারে দুর্লভ এই 'ইকোনোমিক ইউনিটি'। যে কোনও বিলে ঐ যে গণ্ডা খানেক হিজিবিজি ট্যাক্সের, সাড়ে বাহান্ন রকম হ-য-ব-র-ল দক্ষিণার সৌজন্যে আপনার মাঝেমাঝেই কালঘাম ছোটে এবার সেটা মুছে ফেলুন। জি.এস.টি তে এবার সবমিলিয়ে একটাই ট্যাক্স।একটাই টাকার অঙ্ক। জি.এস.টি নাকি সো সিম্পল, সো শর্ট অ্যান্ড সো প্রিসাইস।
২০০৬'র জেনারেল বাজেটে পি.চিদাম্বরম যেবার প্রথম জি.এস.টি'র কথা পেড়েছিলেনে, তখনও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুর থেকে দৌড়ে এসে সংবিধান হাতে বিধানসভা ভাঙচুর করেননি, সৌরভ গাঙ্গুলি  কামব্যাক করে গ্রেগ চ্যাপেলের মুখে ঝামা ঘষে দেননি, সাদ্দাম হোসেন তখন জ্যান্ত আছেন, জ্যোতি বসু তখনও দিব্যি আলিমুদ্দিন আসছেন এবং বাইচুং ভুটিয়া তখনও ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন হয়ে নেহেরু কাপ খেলছেন। জি.এস.টি'র সর্বাঙ্গ যদি এত সুন্দর আর সহজ-সরলই হত তাহলে কি আর লাল-সবুজ কার্পেটে মোড়া সংসদে প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করতেই জেটলি-চিদম্বরমের একদশক সময় লাগত? অবশ্য দিল্লী এখনও বহুদূর। এবার লোকসভায় তারপর কমপক্ষে ১৫টি রাজ্যের বিধানসভার দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা নিয়ে এই বিল পাশ হয়ে রাষ্ট্রপতির দুয়ার ঘুরলে তবে গঠিত হবে জি.এস.টি পরিষদ। তাঁরাই লিখবেন মূল বিলের খসড়া। সেই বিল কে আবার একে একে পেরোতে হবে লোকসভা ও রাজ্যসভার চৌকাঠ, তবে গিয়ে চালু হবে সাধের জি.এস.টি।
বর্তমান মিশ্র ট্যাক্সেশেন পলিসির ক্যাসকেডিং স্টাইলে যেকোনো পণ্যের ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে শুরু করে হোলসেল ঘুরে রিটেল হয়ে আপনি কেনা পর্যন্ত, প্রতি ধাপে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার বিভিন্ন ট্যাক্স আদায় করে। রাজ্য নিজেদের ঘরের হাঁড়ির অবস্থা দেখে প্রয়োজনীয় ট্যাক্স রেটও ধার্য করতে পারে, নতুন ট্যাক্সও বসাতে পারে। যেমন ধরুন, আমাদের দূরদর্শী মুখ্যমন্ত্রী সারদা কাণ্ডে নিজের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ'র ঘুষ খাওয়া টাকা ফিরিয়ে দিতে সিগারেট উপর সেস বসিয়েছিলেন। আবার ধরুন কেরালার নতুন সরকার, বিক্রি কমাতে ফাস্টফুডের উপর বিশেষ ট্যাক্স বসিয়েছে কিংবা প্রবল বন্যার ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে উড়িষ্যা সরকারের লাগু সাময়িক ভ্যাট ইত্যাদি। কিন্তু জি.এস.টি চালু হলে ম্যানুফ্যাকচারিং-হোলসেল-রিটেলে নয় বরং ট্যাক্স বসবে শুধু একবারই, পণ্য কেনার সময়। রাজ্যগুলির হাতেও থাকবে না নিজেদের প্রয়োজন মত ট্যাক্স আদায়ের বা নতুন কোন ট্যাক্স লাগু করার ক্ষমতা। ফলে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু'র মত ম্যানুফ্যাকচারিং রাজ্যগুলি প্রবল রেভেনিউ লসের আশংকায় দীর্ঘদিনই জি.এস.টি লটকে ছিল। এখন অবশ্য গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র'র বিজেপি'র রাজ্য সরকার আর কেন্দ্রের এনডিএ সরকার আমে-দুধে মিশে গেছে। আর আপত্তির আঁটি হাতে নিয়ে তামিলনাড়ু কে আঙুল চুষতে দেখে ফচকে ছোঁড়ারা টুইট কেটেছে "নরেন্দ্র মোদী দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জি.এস.টি'র বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই একই বিল পাশ করিয়েছেন।"
একদিকে ট্যাক্সেশেন পলিসির এই সরলীকরণের ফলে বিভিন্ন রাজ্যগুলির ব্যাপক রেভেনিউ লস আটকাতে চড়া রেভেনিউ নিউট্রাল রেট ধার্য করে ফেডারেল ফিসক্যাল পলিসির মান্যতা রক্ষা অন্যদিকে চিফ ইকনমিক  এডভাইসার অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম সুপারিশ মেনে রেভেনিউ নিউট্রাল রেটকে ১৫%'র মধ্যে রেখে মুদ্রাস্ফীতি রক্তচক্ষুকে সামাল দেওয়া -জি.এস.টি'র ভবিষ্যৎ আপাতত এই শাঁখের করাতেই দোদুল্যমান।  
জি.এস.টি ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স। গরীবের লাইফবয় থেকে বড়লোকিরা হুন্ডা-সিটি, মধ্যবিত্তর এসি থেকে আম্বানি'দের চার্টার্ড ফ্লাইট, জি.এস.টি ওমনিপ্রেসেন্ট, হোমোজিনিয়াস। তাই আর্থিক বৈষম্য কাটাতে ট্যাক্স ব্যবস্থা সত্যি রিফর্ম করে, রাজকোষের শ্রীবৃদ্ধি যদি ঘটাতেই হয় তাহলে ডাইরেক্ট ট্যাক্সের গল্পটাও একটু কড়াই গণ্ডায় বুঝে নেওয়া দরকার। বর্তমানে দেশের জিডিপির মাত্র ১৬.৬% ট্যাক্স। যা উন্নয়নশীল ও ও.ই.সি.ডি'র অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির গড় ২৭.৫% থেকে অনেকটাই কম। আবার ঐ ১৬.৬%'র মাত্র ৫১.৫% ডাইরেক্ট ট্যাক্স। আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল সবচেয়ে ১০% মানুষের হাতেই যেখানে দেশের ৬৬% সম্পদ সেখানে ট্যাক্স বাবদ দেশের মোট জি.ডি.পি তে তাঁদের অবদান মাত্র ৫.৪৭%। গতবছরও  যেখানে জেনারেল বাজেটে ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স বেড়েছে ২০ হাজার কোটি, সেখানে ডাইরেক্ট ট্যাক্স কমেছে ১ হাজার কোটিরও বেশি। ছাড় দেওয়া হয়েছে ৬৮৭১০ কোটি কর্পোরেট ট্যাক্স। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ১০টি 'বিগ বিজনেস হাউস'র অনাদায়ী ঋণ ৭.৫ লক্ষ কোটি।
পরশু প্রধানমন্ত্রী টুইট করেছেন, অরুণ জেটলি কেক কেটেছেন। তা বেশ জেটলি স্যার, এবার তাহলে ঋণখেলাপি ললিত মোদি আর বিজয় মালিয়া কেও লন্ডন থেকে ফিরিয়ে আনা হোক, পরের বার বাজেটে ডাইরেক্ট ট্যাক্সের ফাঁকির হিসেবটাও একবার মিলিয়ে দেখা হোক, 'রেভেনিউ ফোরগেনে'র নামে বারবার কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড়ের নাটকটারও এবার না হয় যবনিকা টানা হোক, বিগ বিজনেস হাউস'র অনাদায়ী ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও না হয় একবার ৫৬ ইঞ্চির বীরত্ব দেখানো হোক। সেদিন না হয় আমরাও টুইট করব। সেদিন আমরাও কেক কাটবো..

ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks