মোক্যাম্বোতে মনীশ ভাইয়ার অপমানের ঘটনার পর সারা শহর রাগে ফুসেছে, ফেসবুকে গালাগালি করে গায়ের ঝাল মিটিয়েছে, বয়কট মোক্যাম্বো নামে বেশ কয়েকটা ফেসবুক গ্রুপ শুরু হয়ে গেছে, মোক্যাম্বোর সামনে ইতিমধ্যেই একটা ধর্না হয়ে গেছে, আগামী শনিবার আরেকটা হবে, শহরের এক সাংবাদিক একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে নিয়ে মোক্যাম্বোতে খেয়ে এসে তার প্রতিবাদ নথিভুক্ত করেছে। এবার আসুন তো বস, একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবি, এই রাগটা আসলে কি নিয়ে?
মোক্যাম্বো যেটা করেছে তাকে আমরা বলি 'এক্সক্লুসিভিটি'। অর্থাৎ তারা এমন একটা অভিজ্ঞতাকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করছে যা 'এক্সক্লুসিভ', সবার জন্যে নয়। মনীশ ভাইয়া মোক্যাম্বোতে খেতে গেছিলো, ইয়ে মানে, মনীশ ভাইয়া মোক্যাম্বোতে খেতে যাবে কি করে? অত ট্যাকের জোর তো তার নেই। তাকে নিয়ে গেছিলেন তার গাড়ির প্যাসেঞ্জার একজন উচ্চমধ্যবিত্ত মহিলা। তিনি না নিয়ে গেলে, মনীশ ভাইয়া বাপের জন্মে মোক্যাম্বোতে খাওয়ার কথা ভাবতো না। এটা তো শুধু মোক্যাম্বোর গল্প না বস। চারিদিকে তো সবকিছুই এরকম 'এক্সক্লুসিভ'। বাজারে মাছ আর সব্জির দাম এক্সক্লুসিভ, সবার জন্যে নয়। উচ্চশিক্ষা এক্সক্লুসিভ, সবার জন্যে নয়। ক্যাফে কফি ডে তে কফির পেয়ালা এক্সক্লুসিভ, সরকারের হিসেব অনুযায়ী একটি পরিবারের এক সপ্তাহের খাওয়ার খরচ উঠে আসবে তার থেকে। সাউথ সিটি মলের বাইরে জয় ইঞ্জিনিয়ারিং এর শ্রমিক দাঁড়িয়ে থাকলে তার জন্যে কতৃপক্ষ কে ব্রিটিশদের মতন গোদা ভাবে 'কুকুর আর ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ' জাতীয় বোর্ড লাগাতে হয় না। মলের দোকানে দ্রব্যমূল্যের প্রাইস ট্যাগ সেই বোর্ডের কাজ করে। স্কুলে ভর্তির সময় কতৃপক্ষ যখন বাচ্চার বাবা মায়ের স্যালারি স্লিপ চায় এপ্লিকেশন ফর্মের সাথে তখন আপনারা রেগে যান না কেন বস? শহরের নামী ক্লাবে মেম্বার হতে গেলে এপ্লিকেশনের সাথে যখন গত ৫ বছরের ইনকাম হিস্টরি দেখাতে হয় তখন রাগ থাকে কোথায়? আমাদের প্রতিদিনের জীবনের প্রতিটা মুহুর্তই তো 'এক্সক্লুসিভ'। শহরের ধনী পাড়া,বস্তি, খেলার মাঠ, কমপ্লেক্স, মল, রেস্তোরাঁ, এমনকি সংস্কৃতিও তো এক্সক্লুসিভ। শ্রেনী, বস, শ্রেনী। শ্রেনীকে অস্বীকার করবে কে? শ্রেনী সত্য, শ্রেনীসত্যই সত্য, এবং তাই এক্সক্লুসিভিটিও সত্য। এই যে দেশে চারিদিকে ধর্ম এবং জাতপাতের ডিসক্রিমিনেশন কে শেষ করতে সমস্ত সচেতন নাগরিক উঠেপড়ে লেগেছে, সবচেয়ে বড় ডিসক্রিমিনেশন তো শ্রেনীবিভক্ত সমাজ। তা সেসব নিয়ে কিছু করবার কথা ভাবছেন নাকি বস? ধুর, জানি তো, ওসব পুরনো বস্তাপচা মাথা আলুর চপ করা ভাবনা ঠিক ফ্যাসনবেল না। খাটুনিও প্রচুর। তারওপরে টিআরপি নেই। মানে জাতপাত কে অস্বীকার করে এগিয়ে চলো বলে স্লোগান দিন, ধর্ম মানি না বলে স্লোগান দিন, সচেতন নাগরিক এবং মিডিয়া বাহবা বলে এগিয়ে আসবে। এবার বলুন শ্রেনীবিভক্ত সমাজ মানি না, উৎপাদন প্রক্রিয়ার মালিকানার সামাজিকরন করো, মিডিয়া পেছনে ঝ্যাটা নিয়ে তাড়া করবে, নাগরিক সমাজ পাভলভে ভর্তি করবার জন্যে চাদা তুলতে মিছিল করবে।
(জিগনেশ মেওয়ানি নামক এক দলিত নেতা বলেছে - দলিতদের সামাজিক স্বীকৃতি দিতে হলে আগে জমি দাও, ব্যাস, আপাতত পুলিশ লকাপে তুলে নিয়ে রেখে দিয়েছে।)
তাহলে আপনি হঠাত মোক্যাম্বোর কেসে এত রেগে গেলেন কেন? আসলে আপনি রেগেছেন অন্য কারনে। মুক্ত বাজার আর পুঁজিবাদ আপনাকে প্রমিস করেছিলো যে ট্যাকে পয়সা থাকলে সব কেনা যায়। আর আমরা তো জানি, ঠিকঠাক মেধা, বুদ্ধি এবং অধ্যবসায় থাকলে আমরা যে কেউ আম্বানি হতে পারতাম। পুঁজিবাদ আমাদের শিখিয়েছে, অসংখ্য র্যাগস টু রিচেস স্টোরির মাধ্যমে, তা ধীরুভাই আম্বানির বাস্তব ইতিহাস হোক, বা 'দ্য পারসুইট অফ হ্যাপিনেস' নামক সিনেমা হোক, শিখিয়েছে যে খাটো, খাটো, খাটো, এবং পৃথিবী তোমার মুঠোর মধ্যে। আমরা কেউই আসলে গরীব না, নিম্নমধ্যবিত্ত না, সবাই ধনী হওয়ার পথে বিভিন্ন দুরত্ব অতিক্রম করেছি মাত্র। মানি স্পিক্স - ফ্রী মার্কেটের মূলমন্ত্র, যা আমরা অমোঘ সত্য বলে মানি (হ্যা সবাই মানি, ওই যে মালগুলো লাল ঝান্ডা নিয়ে ডাউন ডাউন ক্যাপিটালিজম বলে, তারাও জানে না তারা কখন এটা মেনে নিয়েছে), সেই সত্যকে এক নিমেষে ঢপের চপ প্রতিপন্ন করে দিয়েছে মোক্যাম্বো, এবং এখানেই আমাদের রাগ। অবিশ্বাস, হতাশা, অক্ষোমের ক্রোধ। পুরো বিলা কেস তো বস। তাহলে ব্যাপারটা কি? আরে ওই যে আরও কয়েকটা গাঁঁড়ল কিসব বলে - আধা সামন্ততান্ত্রিক-আধা পুঁজিবাদী - কিসব ভাট, কে জানে, ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।
তাই ভেবে দেখলাম, মোক্যাম্বো 'রাইট অফ এডমিশন রিজার্ভড' বোর্ড লটকে বেশ সৎ কাজ করেছে, কারন আপাতত পৃথিবীজুড়ে যে নৈশভোজ চলছে, তাতে ৯০% মানুষের ক্ষেত্রে 'রাইট অফ এডমিশন রিজার্ভড' - খালি বোর্ডটা লটকানো নেই।