Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

চর্বিতচর্বণ ~ মনিপর্ণা সেনগুপ্ত মজুমদার

" আমার বর না ... বিছানায় পড়লেই বাঘ ! "

উঁহু উঁহু, আঁতকে উঠবেন না, নীল ছবিজনিত কোন দৃশ্যকল্প বা আলোচনা নয়, এ এক গভীর সমস্যা। এবং উপরোক্ত মন্তব্যটি নেহাতই বাস্তব।
এ সমস্যা যে কী নিদারুণ তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেন না ...রাতের বেলা ঘুমের মাঝে কী ভয়ানক আতঙ্কে চমকে চমকে উঠতে হয় বা হঠাৎ মনে হয় বুঝি অনেকগুলো বাঘ ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ...এই ঝাঁপিয়ে পড়লো বলে! ভয়ে শিঁটকে গিয়ে সঙ্গীকে ঠেলে তুলে দিতে হয় , যাক্‌ বাবা ...কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চিন্তি। সবে চোখ বুঁজে এসেছে , এমন সম, আবার আবার "ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে " ...ঘুমের দফারফা ।

আরে হ্যাঁ রে বাবা, নাক ডাকার কথাই বলছি। বিভিন্ন স্টাইলের নাক ডাকা আছে , বেশীরভাগই অবশ্য গোদা টাইপ "ঘোঁঊঊঊঊঊঊ " করে এক ভয়ানক চিক্কুর ছেড়ে পর মুহূর্তেই "ভা ভা ভা ভা ঘঁতঘঁতঘঁত হুঁ হুঁ হুঁ " । কিছু ওস্তাদ ডাকিয়েও আছেন । প্রথমে মিঠে তান ধরেন, তারপর আস্তে আস্তে ক্রমশঃ উচ্চকিত হয় স্বর...ঠমক-গমক শুনে বাচ্চারা রাত-বিরেতে ভয়ে চিল্লিয়ে ওঠে। ঠাট্টা - মস্করা করছিনা মশাইরা, জানি নাকের গঠনজনিত কারণে বা ঘুমের সময় মুখের ভেতরের মাংসপেশি শিথিল হয়ে পড়ায় শ্বাস প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়ায় বা এরকম আরো একশো আটটি কারণে মানুষ নাক ডাকে বা ডাকতে বাধ্য হয়। কিন্তু তার ফলে অন্য মানুষের যে জীবনমরণ সমস্যা উপস্থিত হতে পারে তার কথাই বলছি আর কী। সম্মানহানিও হতে পারে। বিশ্বাস না হলে স্বচক্ষে দ্যাখা বা স্ব কর্ণে শোনা দু- একটি ঘটনার উল্লেখ করছি । সঙ্গত কারণেই নাম গোপন রাখতে হচ্ছে ...

'ক' বাবু বাবা হয়েছেন খুব বেশীদিন নয়, কন্যাটির সবেমাত্র আধো বুলি ফুটেছে মুখে । শ্রীমতি 'ক' যেখানে পারছেন সেখানেই এই ক্ষণজন্মা কন্যাটির নানাবিধ গুণপনা ব্যক্ত করছেন এবং বিস্ময়ের অতলে গিয়ে ভাবছেন '' এ মেয়ে বড় হয়ে আইনস্টাইন না হয়ে যায়না '' । তা এরকমই এক সময়ে 'ক' পরিবার নিমন্ত্রণ রক্ষায় এক সান্ধ্যবাসরে উপস্থিত। 'ক' গিন্নী হাসি হাসি মুখে বেড়াল দেখিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করছেন " বল তো সোনা ওটা কী " ...মেয়েও ঝট্‌পট্‌ জবাব দিচ্ছে । আচমকা কছেই কোথাও গভীর, গম্ভীর এক হাম্বারব শোনা যায় এবং খুকি হাততালি দিয়ে বলে ওঠে , "বাবা ডাকছে , বাবা ডাকছে, বাবা আত্তিবেলায় এইলোম কয়ে ডাকে " । তারপরের ঘটনা আর নাই বা বললাম, সহজেই অনুমেয় ।

পতিব্রতা ভার্‌তীয় নারীরা মানিয়ে গুছিয়ে নেন ভাগ্যকে অভিশাপ দিয়ে। গর্জনের সঙ্গে ঘর করতে প্রথম প্রথম অসুবিধে হলেও ( আমার এক বন্ধু তো এক রাতে ' চীঁচঁঈঈঈঈ হোয়াও হোয়াও হোয়াও ঘ্যাস ঘ্যাস ঘ্যাস ' এরকম আওয়াজ শুনে ভেবেছিল ঘুমের মধ্যে বুঝি বা তার বরের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে , অন্তিম সময় উপস্থিত ...তাকে জাগানোর চেষ্টায় বিছানায় জল-টল ঢেলে একাক্কার কান্ড! ) । একেকজন অভ্যস্ত হয়ে যান এমনই যে একসময় ওই বীভৎস আওয়াজ না হলে তাঁদের ঘুমই আসতে চায়না। অনেকে ' শব্দই ব্রহ্ম ' এই তত্ত্ব মেনে নিয়ে যাহোক একটা রফা করে নেন নিজের সঙ্গে বা নিজের নিদ্রাজনিত শান্তির সঙ্গে। বাকিরা গুম্‌রে মরেন এবং ক্যানো বিয়ের আগে একবার ঘুমিয়ে দ্যাখেননি হবু বরের সঙ্গে ( মাইন্ড ইট্‌, ঘুমিয়ে বলা হয়েছে ) সেই ভেবে কপাল চাপড়াতে থাকেন।

এতক্ষণ ধৈর্য ধরে পড়ার পর (যদি আদৌ এতটা পড়ে থাকেন কেউ ) কোন পুরুষ পাঠক আমায় একচোখো ভেবে হয়তো মনে মনে একচোট খিস্তিই দিয়ে ফেলেছেন আর ভাবছেন " বললেই হল , মেয়েরা নাক ডাকে না নাকি !" অবশ্যই ডাকে। এবং সময়ে সময়ে তা অতীব ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়ে সামান্য একটি ঘটনার উল্লেখ করছি ।

দিল্লী চলেছি , রাজধানী থ্রী টায়ার এসি কামরা। প্রায় সকলেই খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েছে, ইতিউতি দু-একটা রিডিং ল্যাম্প ছাড়া সব বড় আলোই প্রায় নেভানো। নাইট বাল্‌ব গুলোর আলো-ছায়ায় বেশ একটা মায়াময় আবহাওয়া। হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে, ট্রেনের আওয়াজ কে ছাপিয়ে এক হৃদয়-বিদারক আর্তনাদ "আআআআআআউঁঁউঁউঁউঁ ওঃওঃওঃ"। সে যে কী পৈশাচিক লিখে বোঝানোর ক্ষমতা নেই আমার !! আশপাশের প্রায় সকলেই প্রচন্ড আতঙ্কে ঘুম ভেঙ্গে কাঠের মত শক্ত হয়ে শুয়ে আছে বেশ বুঝতে পারছি ... আমার উল্টোদিকের বার্থে এক অবাঙালী ভদ্রলোক ছিলেন , তিনি নামতে যেতেই তাঁর স্ত্রী শক্ত ভাবে চাপা কন্ঠস্বরে বললেন, "আরে রহ্‌নে দো জী, উঠো মৎ"। আমি নিজেও ঘুম ভেঙ্গে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময়ে আচম্বিতে আবার সেই চীৎকার! এবার অনেকেই বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। শব্দের উৎস স্থল দু-তিনটি বার্থের পরে একটি সাইড-আপার বার্থ। দুজন ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন, যদি ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে কিছু উপকার হয় ...কারণ ওই আর্তনাদ বা নাক-নিনাদের মধ্যে ট্রেনে অন্য সহযাত্রীদের ঘুমানো অসম্ভব। কিন্তু পরক্ষনেই জানা গেল যে উনি একজন ভদ্রমহিলা। ' ও দিদি , ও দিদি , ও ভাবীজি , ম্যাডাম ম্যাডাম করে হাঁকডাঁক করেও তার ঘুম ভাঙ্গানো গেলনা। কামরার সকলেই প্রচন্ড বিরক্ত । তারমধ্যে দ্যাখা গেল মহিলার সঙ্গী কেউ-ই নেই যিনি তাঁকে সজোরে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে একটু সাহায্য করতে পারেন । মহিলার ঠিক নীচের বার্থের ভদ্রলোক সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে লাগলেন যে এই ধরণের মানুষের ট্রেনে উঠে ঘুমানো প্রায় একটা পানিশেব্‌ল ক্রাইমের মধ্যে পড়ে। যাইহোক , উপায়ান্তর না থাকায় কোনক্রমে রাত টা কাটলো ।
সকালবেলায় আর কেউ-ই ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটালোনা ; কারণ সত্যি কথা বলতে কী সারারাত প্রায় জেগে থাকা আমরা , মানে ভদ্রমহিলার আশপাশের যাত্রীরা সকালের দিকে প্রায় সক্কলেই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে ছিলাম। ওদিকে ট্রেন রাইট টাইম যাকে বলে । বেলা দশটায় দিল্লী।

যাইহোক , ভালোয় ভালোয় পৌঁছে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নামতে একটু দেরি হচ্ছিল আমার, হঠাৎ দেখি যে ভদ্রলোক গতরাত্রে ভদ্রমহিলার বাপান্ত করছিলেন তিনি হাঁচোড়পাঁচোড় করে তিনখানা মস্ত স্যুট্‌কেস টেনে নামাতে গলদঘর্ম হচ্ছেন এবং মহিলাকে বলছেন "আরে তুমি আগে নামো তো, যত্ত গন্ধমাদন বয়ে নিয়ে এসোছো"! অপার বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকাতেই চোখাচুখি হয়ে গেল। যে মিনতি ভরা দৃষ্টিতে তিনি করুণ ভাবে আমার দিকে তাকালেন তাতে বোধহয় পাষাণও গলে জল শুধু না...একেবারে বাষ্পীভূত হয়ে হাইড্রোজেন -অক্সিজেনে পরিণত হবে! যা বোঝার বুঝে নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে নেমে গেলাম তাঁদের পাশ দিয়ে। শুধু ভাবলাম কী সাংঘাতিক এই নাক-নিনাদ ...!

যার জ্বালা সেই বোঝে ।

ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks