"খিস্তি" শব্দটির ভিতরেই কিরকম একটি অনেক না-বলা ব্যঞ্জনা রহিয়াছে। খানিক নিষিদ্ধতা, খানিক ভীতি এবং যৎপরোনাস্তি ঘৃণা- এইসব মিলিত হইয়াই বোধহয় একেকটি বিশেষ শব্দ অসাধারণ অর্থবহ হইয়া উঠে এবং যেকোন মানুষের কর্ণপটাহে তথা মানসসাগরে নিদারুণ যাতনা সৃষ্টি করিতে সমর্থ হয়। কিন্তু সত্যই কি তাই? নাকি সময়, অবস্থান, মানসিকতা এবং ব্যক্তিবিশেষে কোন একটি শব্দের অর্থের তারতম্য ঘটে?
সর্বাগ্রে এই আমার কথাই ধরি। শিশুকাল হইতেই "বইপোকা " হইবার সুবাদে তথাকথিত বড়দের, অতি-বড়দের বই-ও পড়িয়া ফেলিয়াছিলাম। পীতাভ, শুভ্র বা নীলাভ, বই পড়িবার ক্ষেত্রে কোনরূপ বর্ণবৈষম্য না থাকার ফলে আমি জাগতিক প্রায় সমস্ত রকম চলতি অশ্রাব্য গালিগালাজ সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করিয়া ফেলিয়াছিলাম অল্প বয়সেই। তথাপি মুশকিল ছিল যে, কিছুতেই একটি অশালীন শব্দও আমার মুখ গহ্বর হইতে নির্গত হইতে চাহিতনা। মনে মনে ভাবিতাম, বলিব, এই বার ঠিক বলিব, তথাপি কার্যকাল উপস্থিত হইলে কোন্ বারাঙ্গনার সন্তান যে আমার কণ্ঠরোধ করিয়া ফেলিত তাহা ভাবিয়া পাইতামনা। শুধু যে বলিবার সমস্যা ছিল তাহা নহে, কেহ কুবাক্য উচ্চারণ করিলেও রীতিমতন শিহরিয়া উঠিতাম। এমতবস্থায়, এক সুন্দর স্বর্নালী সন্ধ্যায় এক বালক-বন্ধু ইতিহাসে পঁচিশে পাঁচ পাইল এবং সমস্ত সম্পর্কের মাতা-ভগিনী করিয়া শিক্ষিকাকে শ্যালিকা সম্বোধন করিয়া বসিল। আমি যথারীতি চমকাইয়া উঠিয়া তাহাকে নিরস্ত করিবার চেষ্টা করিতেই বিকট মুখব্যাদান করিয়া আমাকে ভ্যাংচাইয়া আমার প্রাপ্ত পূর্ণমানের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনপূর্বক সে আমাকে জানাইল যে এরূপ সম্বোধনই শিক্ষিকার প্রাপ্য, এবং যেহেতু ইহাতে আমার একটিও যৌনকেশ উৎপাটিত হইতেছে না সেহেতু নীরবতা পালনই আমার পক্ষে শ্রেয়!
অদ্যপি সকলেই জ্ঞাত আছেন যে বাঙালী নারী কদাচ এরূপ বাচালতা সহ্য করেনা। সুতরাং আমিও ক্রোধে অন্ধ হইয়া, সমস্তরকম শিষ্টতা বিসর্জন দিয়া 'মূর্খ -সঙ্গমকারী' বলিয়া তাহার হাত মোচড়াইয়া দিয়া দ্রুতপদে সেই স্থান ত্যাগ করিলাম। বালক-বন্ধুটি বিস্ময়াহত হইয়া স্থাণুবৎ হইয়া রহিল। "আমি তখন নবম শ্রেণী"।
সেই শুরু।
তাহার পর কলিকাতার রাজপথ দিয়া বহু জল প্রবাহিত হইয়াছে। আমিও বেশ অনেকগুলি বসন্ত পার হইয়া আসিয়াছি। মাতা ঠাকুরানী যাহা ছিলেন এবং মাতা ঠাকুরানী যাহা হইয়াছেন- তাহার মধ্যে সহস্র যোজন ব্যবধান। অদ্য নানাবিধ কুবাক্য অনায়াসে উচ্চারণ করিতে পারি এবং কী আশ্চর্যের ব্যাপার, এতটুকু পাপবোধ হয়না। শুধুমাত্র তাহাই নহে, উপরোক্ত শব্দাবলী আর তদ্রূপ অশালীন বলিয়াও বোধ হয়না। অবশ্য বহু ব্যবহারে তরবারির শাণিত ফলা-র তীক্ষ্ণতাও হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, আর ইহা তো নিতান্তই আমার নিজস্ব শালীনতা বোধ!
যাহা হউক, এক্ষণে গৌরচন্দ্রিকা যথেষ্ট হইয়াছে, পূর্বোক্ত আলোচনায় ফিরি। "খিস্তি", এক অর্থে প্রকৃত সাম্যবাদের প্রবক্তা। যে খিস্তিসকল নগণ্য রিক্শাওয়ালা দিয়া থাকেন, সেই একই ভাষা আপনি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রকোষ্ঠে বসিয়া আপনার ঊর্ধতন কর্মচারীর প্রতি প্রয়োগ করেন। বলাই বাহুল্য, যে catharsis-ও অভিন্ন দুই ক্ষেত্রেই। আবার, সামান্য দুইটাকা খুচরা না দিতে পারার হেতু অটো ওয়ালা যে মুহূর্তে আপনার চৌদ্দ গুষ্টির গুহ্যদ্বারের একশত আট করিতে থাকেন, তখন যেরূপ মনোবেদনা বোধ করেন, সেই একই বাক্য যখন কোন বন্ধুবর প্রয়োগ করে তখন সেরূপ প্রবল প্রসববেদনা হয়না। ইহার কারণ প্রথমেই উল্লেখ করিয়াছি, ব্যক্তি ও স্থানবিশেষে একই খিস্তির বিভিন্ন অর্থ হইয়া থাকে এবং মনোজগতে তার প্রভাবও ভিন্ন।
একটি উদাহরণ রাখিতেছি; আমার পরম পূজনীয় পতিদেবের এক অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, যিনি উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজে অতীব সম্মানিত, তাঁহার একটি মহৎ দোষ হইল যে হলাহল-সম আসব সামান্য অধিক পরিমাণে পান করিবার পর তিনি কিঞ্চিৎ অস্থির হইয়া পড়েন এবং তখন তাঁহার বাক্যাবলীর মধ্যে পুরুষের প্রধান অঙ্গটির (অধিকাংশ পুরুষের মতানু্যায়ী উহাই তাহাদের প্রধান অঙ্গ, মস্তিষ্ক নহে) একটি চলিত রূপের প্রয়োগ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাইয়া থাকে।
অপর এক বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে কয়েক বৎসর পূর্বে আমার পতিদেব, এবং উল্লিখিত বন্ধুটি তাঁহার গৃহে গমন করেন। উষ্ণ পানীয় সমাপনান্তে যেক্ষণে সকলেই আহারাদিতে ব্যস্ত এবং বন্ধুর মাতৃদেবী স্বয়ং তদারকিতে, সেক্ষণে ইনি হঠাৎ বিগলিত হইয়া গদ্গদ কন্ঠে বলিয়া উঠিয়াছিলেন, (পাঠকের বোধের সুবিধার্থে হুবহু প্রতিলিপি দেওয়া হইল), "মাসিমা, বাঁআ, মাংসটা যা বানিয়েছেন বাঁআ, ওঃ, বহুদিন পরে বাঁআ এমন মাংস খেলাম"।
ইহা শ্রবণ করিয়াও 'মাসিমা' র হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া যে সহসা স্তব্ধ হইয়া যায় নাই, ইহাতেই প্রমাণ হয় যে এই কলিকালেও ভগবান আধা-জাগ্রত অবস্থায় বিরাজমান। ইহাতে আরো প্রমাণ হয় যে কথার মাত্রা হিসেবে, শুধুমাত্র নিজ অভিব্যক্তি প্রকাশের নিমিত্তও কোন কোন সময় খিস্তি ব্যবহৃত হইয়া থাকে। যাঁহারা এরূপ করিয়া থাকেন, কাহাকেও মানসিক আঘাত দিবার জন্য নহে, শুধুমাত্র অভ্যাসের বশেই বলিয়া ফেলেন।
যাহা হউক, আরো একটি ব্যাপার হইল যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ার কারণে নারীজাতির অবমাননা করা হয় খিস্তির মাধ্যমে। উহা লইয়া পৃথক একটি আলোচনা করিবার অভিপ্রায় রাখিলাম।ইয়ে, তেমন গুরুপাক কিছু নহে।