Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

হাইড্রোজেন: একবিংশ শতাব্দীর জ্বালানি স ম আজাদ




হাইড্রোজেন: একবিংশ শতাব্দীর জ্বালানি
স ম আজাদ

এ পর্যন্ত জানা তথ্য অনুসারে প্রকৃতিতে বিদ্যমান মৌলিক পদার্থের সংখ্যা বিরানব্বইটি। এই বস্তুজগতের সবকিছুই মৌলিক পদার্থ দ্বারা গঠিত। অর্থাৎ মৌলিক পদার্থ হচ্ছে সবকিছুর সংগঠনের মৌলিক একক, ইংরেজী ভাষায় যাকে বলে building block of the Universe। এই মৌলিক পদার্থগুলোর মধ্যে সবথেকে সরল মৌল হলো হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন পরমাণুতে মাত্র একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন বিদ্যমান। এজন্য পরমানুর সংগঠন বুঝতে হাইড্রোজেন পরমাণুকে মডেল হিসেবে গণ্য করা হয়। বস্তু হিসেবে রসায়নবিজ্ঞানে এর গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে উৎপন্ন হাইড্রোজেনের প্রায় ৪০% ব্যবহৃত হয় অ্যামোনিয়া উৎপাদনে এবং প্রায় একই পরিমাণে ব্যবহৃত পেট্রোলিয়াম বিশোধনে। কিন্তু ভবিষ্যত সম্ভবত হাইড্রোজেনের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নির্দিষ্ট করে রেখেছে জ্বালানি হিসেবে।
আমরা সকলে জানি তরল হাইড্রোজেন রকেট জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি পোড়ালে যেকোন জ্বালানি অপেক্ষা প্রতি গ্রামে বেশী তাপ পাওয়া পাওয়া যায়। গ্যাসীয় অবস্থায় হাইড্রোজেন একুশ শতকের জনপ্রিয় জ্বালানি হতে পারে। বাতাসে হাইড্রোজেন পোড়ালে কেবলমাত্র পানি পাওয়া যায়।
সুতরাং জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো অপেক্ষা হাইড্রোজেনের দহন অধিক সুবিধাজনক ও পরিবেশ বান্ধব।
জীবাশ্ম জ্বালানির দহন পরিবেশ দূষণের উৎস। কয়লা ও পেট্রোলিয়ামের দহনের কারণে এসিড বৃষ্টি হয়। এই এসিড বৃষ্টি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। জীবাশ্ম জ্বালানিতে সালফার যৌগ আছে। কাজেই এই জ্বালানি দহনের সময় সালফার ডাইঅক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়, এটি আর্দ্র বাতাসের সাথে বিক্রিয়া করে এসিড বৃষ্টির অন্যতম প্রধান উপাদান সালফিউরিক এসিড তৈরী করে।
জীবাশ্ম জ্বালানি দহনে উৎপন্ন প্রধান উৎপাদ কার্বন ডাইঅক্সাইডও প্রধান পরিবেশ দূষক হতে পারে। ঊণিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির দহন ব্যাপকভাবে শুরু হয় এবং এর ব্যবহার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এতে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আবহাওয়াবিদগণ দেখিয়েছেন যে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের বৃদ্ধি গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার  জন্য দায়ী। কার্বন ডাইঅক্সাইডের বর্ধিত ঘনত্ব গ্রিন হাউজের কাঁচের দেয়ালের মতই কাজ করে। এটি অবলোহিত রশ্মি শোষণ করে এবং পৃথিবী পৃষ্ঠে তাপ বিকিরণ করে তাপ শক্তিকে ধরে রাখে,যা জলবায়ুকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।

হাইড্রোজেন অর্থনীতি

বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এর সঠিক জবাব হতে পারে হাইড্রোকার্বন অর্থনীতিকে হাইড্রোজেন অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করা। হাইড্রোজেন অর্থনীতিতে হাইড্রোজেন হবে প্রধান শক্তিবাহক। অটোমোবাইলকে রূপান্তরিত করা যেতে পারে হাইড্রোজেন জ্বালানি ব্যবহারের জন্য। এজন্য নানা অসুবিধা সত্ত্বেও হাইড্রোজেন জ্বালানিঘটিত কার পরীক্ষামূলকভাবে তৈরী করা হচ্ছে। জাপানের Nissan ও Mazda এবং জার্মানিতে Daimler-Benz এ ধরনের কার তৈরী করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। জাপানিরা ঈঞ্জিনের ভেতরে হাইড্রোজেন দহন করে। অন্যদিকে জার্মান-সুইস-ব্রিটিশ যৌথ উদ্যোগে তৈরী ঈঞ্জিনে জ্বালানি কোষে হাইড্রোজেন ব্যবহার করা হয়। হাইড্রোজেন জ্বালানি কোষ ব্যবহার করা ঈঞ্জিনের দক্ষতা ৬০%, যেখানে প্রচলিত পেট্রোল ঈঞ্জিনের দক্ষতা মাত্র ৩৫%।  
হাইড্রোজেন প্রাথমিক শক্তি উৎস নয়, কিন্তু অদূষক জ্বালানি। এজন্য এটিকে পেতে হয় অন্য শক্তি উৎস থেকে। বর্তমানে হাইড্রোকার্বন ও পানি হাইড্রোজেনের প্রধান উৎস। জলীয় বাষ্প রূপান্তর প্রক্রিয়াতে (steam reforming process) উচ্চ তাপমাত্রা ও চাপে নিকেল প্রভাবকের উপস্থিতিতে জলীয় বাষ্প ও হাইড্রোকার্বন পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করে। হাইড্রোকার্বন হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য কার্যকরভাবে শক্তির যোগান দেয়।
হাইড্রোজেন কয়লা থেকে উৎপাদন করা যায় পানি-গ্যাস বিক্রিয়ার সাহায্যে। এই প্রক্রিয়াটি বর্তমানে বানিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু বিশ্ববাজারে পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যয়বহুল হলে তখন এটি গুরুত্বপূর্ণ হবে। এই বিক্রিয়াতে লোহিত-তপ্ত কোক বা কয়লার উপর দিয়ে জলীয় বাষ্প চালনা করা হলে হাইড্রোজেন ও কার্ব মনোক্সাইডের মিশ্রণ উৎপন্ন হয়। কিন্তু বিশুদ্ধ হাইড্রোজেন পেতে হলে কার্বন মনোক্সাইড অপসারণ করতে হয়। এজন্য প্রভাবকের উপস্থিতিতে কার্বন মনোক্সাইডের সাথে জলীয় বাষ্পের বিক্রিয়া ঘটিয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অধিক হাইড্রোজেন উৎপন্ন করা হয়। এরপর ক্ষারের জলীয় দ্রবণে কার্বন ডাইঅক্সাইড দ্রবীভূত করে একে দূর করা হয়। যখন এই দ্রবণকে উত্তপ্ত করা হয়, তখন কার্বন ডাইঅক্সাইড বায়ুমন্ডলে নির্গত হয়, যা ইচ্ছে করলে সংগ্রহ করা যেতে পারে। কিন্তু প্লান্টটি সমুদ্র উপকূলে হলে কার্বন ডাইঅক্সাইডকেগভীর সমুদ্রে অনুপ্রবিষ্ট করানো যেতে পারে।

গবেষকবৃন্দ আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়ার দিকে আলোকপাত করছেন। এই বিক্রিয়াতে সৌর শক্তি ব্যবহার করে পানিকে সরাসরি বিয়োজিত করে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে রূপান্তরিত করা যায়। বাস্তবিকই বিজ্ঞানীরা একটি পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন যাতে সবুজ উদ্ভিদের থেকেও কার্যকরভাবে সৌরশক্তি ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সৌর শক্তি ব্যবহার করে প্রতিযোগিতামূলক দরে হাইড্রোজেন উৎপাদন এখনো একটি চ্যালেঞ্জ। তারপর এর নিম্ন ঘনত্বের জন্য সংরক্ষণ ও পরিবহনের সমস্যাতো আছেই। এ দুটি সমস্যার সমাধানেই  নিহিত আছে হাইড্রোজেন অর্থনীতির সর্ব ব্যাপক ব্যবহার এবং দূষণ মুক্ত বিশ্ব বাস্তবায়নের মৌল ভিত্তি।

[নিবন্ধটি টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'পূর্বাকাশ' ১২ নভেম্বর ২০০৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল]




ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks