কিছুদিন আগেও একটা জোকস বাজার গরম করত। এক ভদ্রলোক এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বসে প্লেন গুলোর ওঠা নামা দেখতে দেখতে আমেজ করে সিগারেট টানছেন। সেইসময় একজন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উপদেশ দিতে শুরু করলেন। "আপনি দিনে কটা সিগারেট খান? কত দামি সিগারেট খান? কতদিন ধরে সিগারেট খাচ্ছেন ?" -এইসব। তারপর একটা হিসেব কষিয়ে তিনি ধূমপায়ী কে বুঝিয়ে বললেন "আপনি যদি সিগারেট না কিনে, পয়সা গুলো জমাতেন, তাহলে আজ সামনের ঐ প্লেনটা আপনার হতে পারতো।" প্রত্যুত্তরে ঐ ধূমপায়ী তাঁকে জিজ্ঞেস করেন তিনি আদেও সিগারেট খান কিনা। নঞর্থক উত্তর পেয়ে পরের প্রশ্ন করেন যে "তাহলে ঐ প্লেনটা কি আপনার ?" উপদেষ্টা ব্যক্তি বেশ বিব্রত হয়ে বলেন "অবশ্যই না।" তখন ধূমপায়ী একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে কিলার পাঞ্চটা দেন- "মাই নেম ইস বিজয় মালিয়া। অ্যান্ড দ্যাট প্লেন ইস মাইন।" মানে,আপনি যদি বিজয়া মালিয়ার মত ধনী এয়ারলাইন ব্যবসায়ী হন তাহলে লাউঞ্জে বসে সিগারেট টানার 'আইন অমান্য' আপনি করতেই পারেন। পয়সা থাকলেই আপনার সাতখুন মাফ।
'কিং অফ গুড টাইমস' বিজয় মালিয়ার ৬০'তম বার্থডে সেলিব্রেশনে গোয়ার বিলাসবহুল ক্যান্ডোলিম ও সিংকুয়েরিম প্রাইভেট বিচের রাতের আকাশ যখন উদ্ভাসিত আলোক সজ্জার আতিশয্যে, ২ ঘণ্টার লাইভ কনসার্টর পর সোনু নিগমকে যখন প্রতিস্থাপিত করছেন স্পেন থেকে উড়ে আসা এনরিক ইগলেসিয়াস, শ্যাম্পেনের মাদকতা আর 'ব্যালেন্ডানো'র সুরে যখন অতিথিরা সম্মোহিত, ঠিক তখনই দেশজুড়ে বকেয়া মজুরি আদায়ের জন্য অনশনে কিংফিশার এয়ারলাইন্সের ক্রিউ মেম্বাররা। ঠিক তখনই দেশের ১৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে কিংফিশার এয়ারলাইন্সের বকেয়া ঋণের অঙ্ক ৯,০০০ কোটি। রঘুরাম রাজন বলেছিলেন "সিস্টেমের কাছে যার এতো ধার বাকি, জন্মদিনের পার্টিতে তাঁর এতো অপব্যয়র বিলাসিতা মানায় না।" নর্থ ব্লকের অনুগত আমলারা অবশ্য রাজন কে আলতো করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন "কারও 'পারসোনাল' ব্যাপারে নাক না গলানোই ভালো।" কিন্তু কোদাল কে কোদাল বলার বদভ্যাস থেকেই কড়া জবাব দিয়েছিলেন রাজন- "যদি কেউ নিজে অনাদায়ী ব্যাংক ঋণের 'পারসোনাল' গ্যারেন্টার হন এবং বিপুল পরিমাণ ধার বকেয়া রাখেন তাহলে তাঁর 'পারসোনাল' লাইফে নাক তো গলাতেই হবে।"
ক্রেডিট সুইসের তথ্যানুসারে দেশের ১০টি 'বিগ বিজনেস হাউস'র অনাদায়ী ঋণের মোট পরিমাণ ৭.৫ লক্ষ কোটি টাকা। ক্রেডিট রেটিং সংস্থার হিসেবে যার ৫০%'ই 'ডিফল্ট' এবং প্রয়োজনে সরকারের তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেই এই বিপুল বকেয়া ঋণ আদায় করতে পারে। কিন্তু বিজনেস হাউস নাম যখন এসার, ভেদান্ত, জিন্দাল, আম্বানি, আদানি -তখন দেশের সরকারের ঘাড়ে কটা মাথা যে এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে? ার নিলে নির্বাচনী প্রচারে "অবকি বার/মোদী সরকারের" তুমুল প্রচারের বিপুল টাকা কে ঢালবে? হবুমন্ত্রী আর গবুরাজা কে উড়ে বেড়াতে প্রাইভেট চপারই বা কে দেবে?
কিন্তু সরকার ও বিগ বিজনেস হাউসের আন্ডার টেবিল সমঝোতার গলার কাঁটা হলেন রাজন। সমস্ত ব্যাংক কে তিনি নির্দেশ দিলেন "অন্যায় সুবিধা না দিয়ে এই বিগ বিজনেস হাউস গুলির অনাদায়ী ঋণ দ্রুত আদায় করতে হবে।" ফলত ১৯৯৯-২০০০'র 'এশিয়ান ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিসের' সময়েও যে এসার গ্ৰুপ প্রায় 'ঋণখেলাপি' হয়েও ব্যাঙ্ক'র দয়ায় আর নেতা-মন্ত্রী'দের আনুগত্যে পার পেয়ে যাচ্ছিলো তারাও এবার নিজেদের সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে বকেয়া ঋণ আংশিক মেটাতে বাধ্য হয়েছিল।
৩১শে মার্চ কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রকের অধীনস্থ, 'ডাইরেক্টরেট অফ রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স', তাদের এক 'জেনারেল এলার্টে' প্রায় ৫০টি কয়লা আমদানিকারী সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা 'স্টিম' কয়লার দাম সংস্থাগুলি বে-আইনি ভাবে বাড়িয়ে রেখেছে। যেখানে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা কেনা, মালবাহী জাহাজের খরচ ও কাস্টম ডিউটি সহ কয়লার আমদানিকৃত দাম হয় উচিত ৩৩৫০ টাকা/মেট্রিক টন সেখানে এই সংস্থাগুলি বিভিন্ন স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ড ও কর্পোরেশন কে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে ৫৪৯৪/মেট্রিক টন হিসেবে। ফলে আপনাকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ'র জন্য বেশি দিতে হচ্ছে প্রায় ১টাকা ৫০পয়সা। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রীর তথ্যানুসারে আমরা যেখানে প্রতিবছর বিদেশ থেকে মোট ১লক্ষ ৫হাজার কোটি টাকার কয়লা আমদানি করি সেখানে এই দুর্নীতির পুঞ্জীভূত মোট অঙ্ক প্রায় ৫০, ০০০ কোটি। মুম্বাইয়ের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আইন মন্ত্রকের জমা দেওয়া রিমান্ডে এই দুর্নীতিতে নাম আছে রিলায়েন্স, আদানি, জিন্দাল, এসার মত রাজনের চক্ষুশূল বিগ বিজনেস হাউসগুলিরই। তাই রঘুরাম রাজন কে চলে যেতে বাধ্য করা নিতান্তই রুটিন ওয়ার্ক, কিম্বা অর্থমন্ত্রীর সাথে 'লো ইন্টারেস্ট রেট' আর মুদ্রাস্ফীতির তু তু ম্যা ম্যা নয় বরং 'রিস্কলেস ক্রনি ক্যাপিটালিজমের' পথের কাঁটা সরাতে আস্ত একটা 'মোডাস অপারেন্ডি'। ঐ যে বলে না, দেয়ার ইস অলওয়েজ অ্যা 'মেথড ইন ম্যাডনেস'।
যে দেশে ঋণখেলাপি ললিত মোদিরা পায়ের উপর পা তুলে নিশ্চিন্তে লন্ডনে বসে থাকেন, যে দেশে বিজয় মালিয়ারা রাজ্যসভার সাংসদের পদ অলঙ্কৃত করেন, যে দেশে ওত্তাভিও কাত্রোচ্চিরা বোফোর্সের পরও কলার তুলে ঘুরে বেড়ান, যে দেশে ওয়ারেন অ্যাণ্ডারসেনরা ভোপালে নির্বিচারে মানুষ মেরে মন্ত্রীদের প্লেনে চেপে পালিয়ে গিয়ে আমেরিকায় নিশ্চিন্তে মরেন, সে দেশে রঘুরাম রাজনরা থাকতে পারেন না। সে দেশে সতেন্দ্র দুবেরা বাঁচতে পারে না। সে দেশে মুদ্রাস্ফীতি কমতে পারে না। সে দেশ ক্রনি ক্যাপিটালিজমের। সে দেশ সুব্রহ্মণ্যম স্বামীদের। সে দেশ হাম্বার। সে দেশের গোবরই ভিত্তি। সে দেশের ঘুঁটেই ভবিষ্যৎ...