Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

যুদ্ধ ~ সুশোভন পাত্র

ঐ তো অগ্নিদগ্ধ হয়ে শুয়ে আছেন জম্মুর হাবিলদার রভি পাল, ঠিক তাঁর পাশে, ঝাড়খণ্ডের সেপাই জাভ্রা মুন্ডা। কালাশনিকভের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিশ্বজিৎ গরাই আর মহারাষ্ট্রের নায়েক শঙ্করের বুকটা। হ্যালোজেনের আলসেমি ভেজা রবিবারে কাকভোরে তখনও অবশ্য ঘুমই ভাঙেনি সেভেন রেস কোর্স রোড কিম্বা রাইসিনা হিলের নিশ্চিন্ত বাসিন্দা'দের।

স্বাভাবিক কারণেই,স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে,গর্জে উঠেছে ডাল মাখনি থেকে ইডলি-ধোসা হয়ে ইলিশ ভাপা। স্টার জলসার বিজ্ঞাপন বিরতি তে দীর্ঘশ্বাসের ফাঁকে ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়েছে -'খুন কে বদলা খুনের' অঙ্গীকার। সময়ের পাতনে, গত এক সপ্তাহে অবশ্য সেই বাক্যবাণের অনুরণন, ক্রমশ থিতু হতে হতে ব্র্যাঞ্জেলিনার ডিভোর্সের ঘণ্টাখানেক আলোচনায় বোতলবন্দী। আসলে সীমান্তের চড়াই উতরাইয়ে লাশ কুড়ানোর অভ্যাস আছে আমাদের। ২০০২'র কালুচক ক্যান্টনমেন্টে ৩১, ২০১৩'র শ্রীনগরে সি.আর.পি.এফ ক্যাম্পে ৫, ২০১৫'র গুরুদাসপুরের রাস্তায় ৭, গত জানুয়ারির পাঠানকোটে সেনা ছাউনি তে ৮। এবার সীমান্ত লাগোয়া উরির কাঁটাতার ঘেঁষে সারিবদ্ধ ১৮টা রাষ্ট্রায়ত্ত লাশ। অ্যান্ড দা লিস্ট গোস অন। অ্যান্ড অন...
ক্রোধোন্মত্ত দেশবাসীর ঘৃণার বারুদে অগ্নি সংযোগে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় অবিশ্বাস্য তৎপরতায় হাজির ভারত-পাকিস্তানের সমরসজ্জার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিসংখ্যান। পরমাণু অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র, সামরিক বরাদ্দ, সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার, ট্যাঙ্কারের ধারে-ভারে কয়েকশ যোজন এগিয়ে 'হিন্দুস্থান'। বিজেপি প্রেসিডেন্ট রাম মাধবের টুইট 'দরকারে একটা দাঁতের জন্য গোটা চোয়াল উপড়ে নিতে হবে'। তর্কপ্রিয় অর্ণব গোস্বামীর শিশুসুলভ নিষ্পাপ প্রশ্ন "নেশন ওয়ান্টস টু নো, হোয়াই নট কোভার্ট অপারেশন?" রিটায়ার্ড আর্মি চিফ জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরী বলছেন 'ফিদায়ীন' বানিয়েই বদলা নিতে হবে।

আরবি শব্দ ফিদায়ীন' অর্থে 'সুইসাইড বোম্বার।' ৭১'র বদলা নিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর দ্বৈত সামরিক 'মাস্টার প্ল্যানের' একটা ছিল এই 'ফিদায়ীন' গ্ৰুপ তৈরি। পরে নয়ের দশকে বেনজির ভুট্টোর ক্যাবিনেটের 'কিং মেকার' নাসিরুল্লা বাবরের সতর্ক নজরদারি তে এই ফিদায়ীন সংশ্লেষিত 'আফগান সেলের' কড়া তত্ত্বাবধানেই ভূমিষ্ঠ হয় সর্বজন নিন্দিত 'তালিবান'। তাহলে কি 'ফিদায়ীন' থেকে 'ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন' তৈরির ঐ বিপজ্জনক পথেরই পথিক হব আমরা? শহীদ জওয়ান'দের বলিদানের মূল্য চোকাতে, আরও কিছু নাগরিক'দের হাড়িকাঠে চড়াব আমরা? কাদের সঙ্গে যুদ্ধ আমাদের? ১৬ আনা উচ্ছন্নে যাওয়া ইসলাম মৌলবাদী আর উগ্র দেশপ্রেমের বিষবৃক্ষ বুকে বয়ে বেড়ানো পাকিস্তানের সাথে? না নিজেদের সাথে? পরমাণু বিধ্বস্ত লাহোরের রক্ত ৩০ কিলোমিটার দূরে অমৃতসরের রাস্তায় বইবে না? বন্দর শহর করাচির বারুদের গন্ধ কচ্ছের রণের বাতাসে মিশবে না? বর্তমানে যুদ্ধের আনুমানিক খরচ ৫ হাজার কোটি/দিন এক পাক্ষিক কালের যুদ্ধে দেশের রাজকোষ ঘাটতি এক লাফে বেড়ে হতে পারে ৮ লক্ষ কোটি। ২০০ টাকা/কেজি ডালের দেশে যুদ্ধের এই বিপুল খরচ বইবে কোন গৌরী সেন?
এন.এই.এ'র তদন্তে আশঙ্কা সেনা ছাউনির ভৌগলিক নকশার সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল জঙ্গি'দের কাছে। খবর ছিল, ১০ডোগরা রেজিমেন্টের কাছ থেকে বিহার রেজিমেন্টের রুটিন দায়িত্ব হস্তান্তরেরও। হাই সিকিউরিটি জোনের কাঁটাতার দু-জায়গায় কেটে, ১৫০ মিটারের উন্মুক্ত অঞ্চল আর সেনা পাহারার নিশ্ছিদ্র বলয় পেরিয়ে, ৪ জঙ্গি নিশ্চিন্তে পৌঁছে গেলেন  একেবারে অলিন্দে। যে জওয়ানরা সিয়াচেনের বরফে জমে দেশ আগলায়, যে জওয়ানরা ঘরের খেয়ে সারাজীবন বনের মোষ তাড়ানোর হিম্মত দেখায়, যে জওয়ানরা রাষ্ট্রসংঘ বোঝে না, সার্কের গোল টেবিলে বৈঠক করে না, তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে এতো অবহেলা? যুদ্ধ যদি করতেই হয় তাহলে যে গঠনতন্ত্রের আমলারা কূটনীতির জটিল অঙ্ক কষতে গিয়ে শহীদের নিরাপত্তা দেবার সরল পাটীগণিতের গুন-ভাগে ভুল করেন সেই গঠনতন্ত্রের বিরুদ্ধেই করুন। যুদ্ধ যদি করতেই হয় তাহলে, যে নেতা-মন্ত্রীরা অশ্রুস্নাত জওয়ান'দের কফিন নিয়ে কেলেঙ্কারি করেন তাঁদের বিরুদ্ধেই করুন।    
গত আড়াই মাসে কাশ্মীরে লাগাতার কারফিউ আর জঙ্গি আন্দোলনের শাঁখের করাত সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় শ্রীনগরের 'সন্ত্রাস দমনে'র তথ্য পরিবেশনকারী মাল্টি এজেন্সি সেন্টার। গত দু-মাসে এল.ও.সি বরাবর অনুপ্রবেশর নির্দিষ্ট তথ্যই নেই গোয়েন্দা বিভাগের কাছে। গত কয়েক সপ্তাহে কাশ্মীরে আত্মগোপন করেছে কয়েকশ যুবক। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দয়া করে, পরিসংখ্যানের কচকচানিটা বুঝুন। চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়া নিতান্তই নাবালোকচিত। কাশ্মীর আমাদের পর নয়। পেলেট বিদ্ধ ১১ বছরের কাশ্মীরের আপেল রাঙা ছেলেটাও সন্ত্রাসবাদী নয়। রক্তে ভেজা কাশ্মীরের ইতিহাস সে কথা বলে না।

১৯৪৭-৪৮'এ কাশ্মীরের দখলদারি নিতে আসা পাকিস্তানের হানাদারের ভাগিয়ে দিয়েছিলো কাশ্মীরের সাধারণ মানুষরাই। ১৯৬৫ তে আয়ুব খানের 'অপারেশন জিব্রালটার' ৪০ হাজার অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল আজকের পেলেট বিদ্ধ কাশ্মীরিদের পূর্বসূরিরাই।    

সুব্রহ্মণ্যম স্বামী ১০ কোটি ভারতীয় কে পাকিস্তানের সাথে পরমাণু যুদ্ধে আত্মত্যাগের জন্য তৈরি থাকতে বলেছেন। তা ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী জী, ১০ কোটির একজন হতে, আপনার ক্যাবিনেটের গবু মন্ত্রীরা তৈরি তো? আপনার সঙ্ঘ পরিবারের মোড়লরা তৈরি তো? আপনি নিজে তৈরি তো? এই তো সেদিনও আপনি জওয়ান মরলেই 'দুর্বল দিল্লী' সরকার বিরুদ্ধে টুইটারে ঝড় তুলতেন, মিতভাষী মনমোহন সিং কে ব্যাঙ্গ করে পাড়ার রকের মস্তানের মত রংচটা বিবৃতি দিতেন। মৃত সৈনিকের লাশের সওয়ার হয়ে দিল্লীর মসনদ দখলের স্বপ্ন দেখতেন। অথচ দেখুন, সেই আপনিই আজ বাজপেয়ী-মনমোহন পথে হেঁটে 'কূটনৈতিক মোকাবিলার' কথা বলছেন। আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তান কে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন। জিও-পলিটিকাল স্ট্র্যাটেজির অজুহাতে শ্যাম আঙ্কল'দের বাধ্য ছেলের মত, ওয়াশিংটনের 'ধরি মাছ না ছুঁই পানির বিবৃতি' মুখ বুঝেই সহ্য করছেন। তা বেশ! তাই না হয় করুন। আজ না হয়, পেলেট আর পাল্টা ইট বৃষ্টির মৃত্যু মিছিলে লাগাম টানুন, আজ না হয়, কাশ্মীরী'দের আস্থা অর্জন করে পাকিস্তানের মুখে জব্বর একটা ঝামাই ঘষুন, আজ না হয় কাশ্মীরে সকলের সাথে কথা বলে শান্তি ফিরিয়ে আনুন, আজ না হয় আপনার ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে সীমান্তের জওয়ান'দের আগলে রাখুন। দোহাই আপনাকে, আজ না হয় একবার, প্রথমবার, কথাটা কম, আর কাজটা একটু বেশীই করুন।

ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks