Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

গোর্কির ‘মা’ রা এখনো আছেন ~ পারিজাত ভট্টাচার্য্য



ধান্যরুখি গ্রামে একটাই বুথ। সেই গ্রামে একটাও পার্টি সদস্য নেই। তাদের কাছে পার্টির তথা সংগ্রামের একটাই মুখ ছিলো ওখানকার স্থানীয় প্রিয় নেতা, মঙ্গলকোট উত্তরের শ্রী ফালগুনি মুখার্জি। এই কমরেড মুখার্জিই ছিলো কংগ্রেসী থুরি তৃনমূলিগুন্ডাদের একমাত্র লক্ষ্য। কমরেড ফালগুনি মুখার্জি শহিদ হাওয়াতে ওই এলাকাটা ফাঁকা হয়ে গেলো। আমরা সেই ধান্যরুখি গ্রামে ৭৫% ভোট পাই মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে। সেই মানূষ টিকে মেরে দিলো সেই গ্রামের প্রাক্তণ জোতদার-জমিদার বাহিনীর পোষা গুন্ডাবাহিনী। ফাল্গুনি কে মারার কিছু আগেই সেই চক্রান্তকারিদের দল সহ জোতদার বাহিনী পাল'রা সেই এলাকা থেকে হাওয়া হয়ে গেলো। ফাল্গুনি কে খুন করা হয় সকাল ৯-১০ এ, সকাল ৮টা থেকেই ওই গ্রামের মানুষ জ়োতদার দের আর দেখতে পান নি। ফাল্গুনি মারা যাবার আগে সেই খুনি দের নাম বলে যান। যে বা যারা খুন করলো তাদের হয়ে সাফাই গাইতে শুরু “পরিবর্তনকামী” সুশীল সমাজ এবং তৃনমূল এবং কংগ্রেসের “জনপ্রতিনিধিরা”। তাদের হয়ে হুঙ্কার দেওয়া হলো, পুলিসের সাহস থাকে তো গ্রেফতার করুক। এই হচ্চে দিদির “শহিদ দিবসে” শান্তির বানী। তথাকথিত বাংলার পাল রাজাদের অনুগত বারো ভুঁইয়ার বংশবদরা এখনো আমাদের বঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি তে যথেষ্ট তৎপর। তাদের মধ্যে এক ভূঁইয়ার শ্রেনীচরিত্র প্রায় সকলের জানা। তা তিনি সেখানে ত্রাণ দিতে গেলেন, এবং ত্রাণসামগ্রী হিসেবে নিয়ে গেলেন সেই কুখ্যাত খুনি গুলিকে। গ্রামে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে গ্রামের মা, বোনেরা রুখে দাঁড়ায়। তাঁদের ভয় দেখাতে ভুঁইয়া বাহিনী বন্দুক দেখায় এবং গনতান্ত্রিক পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখার জন্যে গ্রামের সর্বসাধারণেরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ঢিল , পাটকেল ছূড়ে সেই গুন্ডাবাহিনী কে গ্রাম থেকে তাঁরা তাড়ান। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ মঙ্গলকোটের মায়েরা পড়েছেন কি না জানা নেই। কিন্তু আঁতুড়ঘর থেকে একজন কমিঊনিষ্ট কর্মীকে গড়ে তোলার কারিগর যাঁরা তাঁদের সন্তান হারানোর ব্যাথা, বেদনার কান্নার দৃশ্য বধির মিডিয়াকে ব্যাথিত করেনি। বরঞ্চ খুনিদের পক্ষ নিয়েই ওকালতি করতে দেখা গেছে ওদের। কমিউনিষ্টদের হত্যা করার ঘটনাকে নিন্দা করা তো দুরের কথা প্রকারান্তে দেখা গেছে খুনিদের বাঁচাতে ময়দানে নেমেছে প্রচারমাধ্যমই। ফাল্গুনি মুখার্জি খুন মিডিয়ার কাছে কখনই দুঃখ্যজনক বড় ঘটনা বলে গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু এই খুনের বিরুদ্ধে মঙ্গলকোট জ়ুড়ে মানুষের ক্ষোভ, ঘৃনা থেকে উদ্ভুদ পরিস্থিতি যখন জনরোষে পরিনত হলো তখন এই প্রচারমাধ্যমই মায়েদের প্রতিবাদের ভাষাকে ‘সন্ত্রাস’ আখ্যা দিতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করলো না। ক্ষোভ, ঘৃণা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখে দিশেহারা কংগ্রেস , তৃনমূলের তোল্লাইদাতা মিডিয়াকুল। এই সাম্রাজ্যবাদীদের মদতদাতা মিডিয়াকুল , সুশীল সমাজ, ফেসিয়াল করা বাবু-বিবিদের দল , মানবাধিকার কমিশনের বাবুবৃন্দ, আনন্দবাবুগণ ‘হৃদয়বিদারক ‘ চিৎকার, কুমিরাশ্রু, মায়াকান্না জ়ুড়ে দিলেন যখন বারোভূঁইয়া বাহিনী কে গ্রাম থেকে গ্রামের মা, বোনারা বিতাড়িত করলেন। কিন্ত কোথায় ছিলো তাদের দরদ যখন তাদেরই একসময়কার “ফ্যাসিস্ত” শরিক, ভূঁইয়া বাহিনীর মদতদাতা সুভাষ ঘিসিং কে পাহাড়ে উঠতে দেওয়া হয় নি, তার স্ত্রীর মৃতদেহ, তার নিজ্বস্ব জন্মস্থান কার্শিয়াং এ আনতে দেওয়া হয় নি, যখন কার্সিয়াং এর বিধায়ক শান্তা ছেত্রীকে পাহাড়ে উঠতে দেওয়া হয় না, রাজ্যের দ্বায়ীত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য্য কে তার বিধানসভা ভুক্ত এলাকা মিরিকে যেতে দেওয়া হয় না। জি এন এল এফ এককালে, এককালে কেন? এখনো বোধহয় কংগ্রেসের শরিকথুড়ী মিত্র, কিন্তু হায়। জোট এর ঘোট বড় বালাই। সুশীল সমাজ সমাজ, মিডিয়াকূল চুপ থাকেন যখন খেজুরি “দখল” করে সেখানে শুভেন্দু অধিকারী লাল ঝান্ডা বাহকদের নির্মূল করার ঘোষনা করেন, যখন সেখানে চার বিধায়ক ঢূকতে চাইলেও তাদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। দিনের পর দিন লালগড়, নন্দিগ্রাম সিঙ্গুর অবরোধ করে, সেখানে পূলিস - প্রশাসন ঢূকতে পারেন না, যখন লালগড়ে রাজ্য-কেন্দ্রীয় যৌথ বাহিনীর প্রবেশ কে শকুনি জিন গত গোষ্টির প্রতিনিধিরা প্রতিবাদ জানায়, যখন কেন্দ্রীয় সরকারের বলবৎ ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে, কেন্দ্রীয় সরকারের তৃনমূলি শরিক কেন্দ্রীয় সংসদরা মাওবাদী উপদ্রুত অঞ্ছলে গিয়ে নতুন করে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরী করে আসেন। ইস, জোটের ঘোট বড় বালাই।





১৬ ঐ জুলাই ২০০৯ এ, অবরোধ কোনো বিধায়ক বা জনপ্রতিনিধিদের করা হয় নি, অবরোধ করেছিলো জনসাধারণ তাদের প্রিয় নেতা ফাল্গুনী মুখার্জির খুনি দের। গ্রামের মহিলারা ছিলেন অগ্রভাগে, নেতৃত্বে। কিন্ত সেইদিন সেই ঘটনার জন্যে একতরফাভাবেই দায়ী করা হলো সেই গ্রামের মা- বোনেদের। প্রচারমধ্যমের “নিরপেক্ষতা” সম্মন্ধে মহ কাটলো মঙ্গলকোটের। অনেকেই মনে করতেন, ছাপার অক্ষরে, বৈদ্যুতিন সংবাদমাধমে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু সত্য লুকিয়ে থাকে। কিন্তু ভুল ভাঙলোতাদের। দেখলেন যে আমজনতার থেকে খুনিদের স্বার্থ বেশী করে দেখে এইসব বাজারী সংবাদমাধ্যম, বাবু-বিবিদের দল। যারা খুনি সাথে নিয়ে এলেন তাঁরা হলেন সব সাধু আর গ্রামের লোক হয়ে গেলেন অপরাধী। এই হয়েছিলো গ্রামের লোকের ধারণা। মানবাধিকার কমিশনের বাবুরা তাড়াহুড়ো করে এসেছিলেন সেদিনের ঘটনা “তদন্ত” করতে, অর্থাৎ খুন নয়, বিধায়করা দৌড়ালেন কেন, তার “স্টোরি” কালেক্ট করতে। সাথে উদ্গ্রীব সংবাদমাধ্যম। গ্রামে তারা আসলেন ভালো কথা , বিধায়করা তাড়া করলেন, অনুসন্ধান করতে আসলেন, আরো ভালো কথা, কিন্তু ফাল্গুনি মুখার্জি কে খুন কে বা কারা করলেন, কেন করলেন , তখন আপনারা গেলেন কই। তখন আপনাদের দরদ কোথায়? কোন শ্রেনীর স্বার্থরক্ষা করতে বিনিদ্র রজনী যাপন করছেন আপনারা? ফাল্গুনি বাবু কি জনপ্রতিনিধি ছিলেন না? উত্তর দিন , সঠিক উত্তর, শঠতা করবেন না, করলে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কিন্তু আপনাদের ক্ষমা করবে না। মঙ্গলকোটের হাজার মা-বোনেদের ক্রোধ, ঘৃণা এবং তার রোষ ছিলো, ছাই চাপা আগুনের মতন। এই প্রতিবাদী মায়েদের ধৈর্য্য পরিক্ষাকে বাহবা দিতে হয়, কুর্নিশ করতে হয়। খুনীরা তখন গ্রেফতার হয়নি, অথচ মঙ্গলকোটের প্ররোচনা দিতে, ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে একের পর এক এসেছেন কংগ্রেস এবং তৃনমূল এর নেতারা।





সেদিন মঙ্গলকোট সাথে সারা বাংলা দেখলো একজন কমিনিস্ট নেতার জন্যে সাধারণ মানুষ, গাঁ এর মা-বোনেদের দরদ, আকুতি, বিলাপ। এই মায়েরা কাঁদতে জানেন সন্তানের জন্যে আবার খুনিদের বিরুদ্ধে জনপদের দাঁড়িয়ে প্রতিরোধের প্রাচীরও গড়তে জানেন। রাজ্যে মানূষ দেখেছেন যে সেইদিন তৃনমূল এবং কংগ্রেসী সন্ত্রাবাদীদের সাহস হয়নি সেই পাচিল ডিঙিয়ে এগিয়ে যাবার। সেই অবস্থান ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত মায়েদের খুনের বিচারের দাবিতে। নিজের মানুষের কাছে প্রাণ খুলে কেঁদেছেন হারানো প্রিয় সন্তানের জন্যে। সেই সাথে তাদের চোখে দেখা গেছে ক্রোধ। ফাল্গুনি মুখার্জিকে একজন মা গর্ভে ধরেছিলেন কিন্তু হাজার মায়ের সন্তানের পরিচয় নিয়েই তিনি আজও বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে। কে বলে ফাল্গুনি মুখার্জি বেঁচে নেই, মাঠে, ঘাটে, হাটে, আমজনতার মিছিলের আগে, এই মানুষটি আছেন একজন আদর্শ কমিউনিস্ট হিসেবে। কিন্ত স্নেহ, ভালোবাসা, আদর্শ এই বধির প্রচারমাধ্যমকে স্পর্শ করবে না, ফেসিয়াল মার্কা বাবু-বিবিদের তৈরি করা অদৃশ্য দেওয়ালও ভেদ করবে না। মঙ্গলকোটের ইতিহাসে কৃষক আন্দোলনের কথা, কৃষকদের আত্মত্যাগের কথা বিশেষ ভাবে স্মরনীয়। ১৯৬৯ সালে মঙ্গলকোটের চৈতন্যপুরের প্রথম গতিশীল কৃষক আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে সংগঠিত জোটদাররা গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিলো ২ জন কৃষককে। আহত হয়েছিলেন ১০৪ জন গরিব খেতমজুর। মঙ্গলকোটের মাটি সেদিন রক্তে ভেসে গিয়েছিল। সেদিনও আনন্দবাবু, যুগান্তরেরা জোতদারদের পক্ষ্য নিয়েছিলো। এদের শ্রেনী চরিত্র একই আছে, বদলেছে শুধু হিংসার কৌশল। মঙ্গলকোটে অতিতে মজুরি, জমি, বর্গা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলো তাদের চোখে কৃষকদের জন্যে কুমিরাশ্রু। গন-আন্দোলনের উর্বর মাটি মংঙ্গলকোট, এইখানকার মানুষ শত্র চিনতে তাই ভুল করে না। মেঘের আড়ালে বা মুখোশ পরে থাকলেও শত্রু চেনেন মঙ্গলকোটের মানুষ। খুনের রাজনীতিকে প্রতিহত করেই গনতান্ত্রীক আন্দোলনের দিশা দেখিয়েছে মঙ্গলকোটের মানুষ, পশ্চিমবঙ্গের গনতান্ত্রিক প্রিয় মানুষকে নতুন আশায় বুক বাঁধতে শেখালো মঙ্গলকোটের মানুষ।





লাল সেলাম, শিলিগুড়ি থেকে পারিজাত ভট্টাচার্য্য।

ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks