সুভাষের সঙ্গে আমার পরিচয় তখন, যখন ভারতে উগ্র জাতিয়তাবাদ- ফ্যসিবাদি রূপ ধারণ করছে। যখন লাল জামা পরার অপরাধে মেয়েদের গায়ে ব্লেড চালাতেও দ্বীধা করতো না এক কংগ্রেসি ছাত্র নেতা, যিনি বর্তমানে সাংসদ। যখন ‘চিনা বাদাম’ বলার অপরাধে এক ১৬ বছরের হকার কে রাস্তায় ফেলে পেটান হ’ত। ভেঙে দেওয়া হ’ত অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টী –র পার্টী আফিস। যখন শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধীজীবিরা, আনন্দবাজার-এর নেতৃত্বে মুক্ত সমাজ করে, প্রতিদিন কমিউনিষ্ট নিধনে যুক্তি সরবরাহ করতো। আজকে যারা সুশীল, অনেকেই সেই সময় এর সাথে যুক্ত ছিলেন, এমনকি তাদের অনেকের বাবা-মা-রাও ব্যস্ত থাকতেন উগ্র কমিউনিষ্ট বিরোধীতায়। মনোজ বসুর মত লেখক, তার ‘চিন দেখে এলাম’ বইটি কলেজ ষ্ট্রীট এ নিজেই পুরিয়ে ছিলেন। পরে অবশ্য ৭৭ এ বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আশার পর, বাম নেতাদেরই পাশে রেখে আবার প্রকাশ করে ছিলেন। ওরকম একটা ফ্যসিষ্ট অভ্যুত্থানের মধ্যেই ওর সাথে আমার আলাপ।
আজ পশ্চিম বাঙলায় আবার ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানের পদদ্ধনি। বাঙলার গ্রামে গ্রামে প্রাক্তন সামন্ত প্রভুরা – কেউ সাংসদ হয়ে, কেউ অঞ্চল প্রধান হয়ে নিজেদের হৃত জমি পুনরুদ্ধারে নেমেছে।
সি পি আই (এম) খ্যদাও অভিযানের নামে, আসলে তাদের যে সমস্ত জমি খাস হয়ে গেছিল, এবং গ্রামের ভুমিহীন ক্ষেত মজুর পাট্টা হিসেবে পেয়েছিল, মেদনিপুর, ২৪পরগনায় সেই সব কৃষকদের ব্যপক উচ্ছেদ করা হচ্ছে। আসলে তারা সামন্তরাজ কেই প্রতিষ্টা করতে চাইছে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে। লাল পতাকা কে খতম করার কাজে নেমেছে। এ ষরযন্ত্র অত্যন্ত গভীর। আজ যখন ৯৬ জন বামপন্থী কর্মী খুন হন, ৫৮ টা বামপন্থী দল গুলোর পার্টী অফিস পোড়ে, ৬০০০ লোক উচ্ছেদ হয়, ৩০জন আদিবাসী খুন হন, তখন পশ্চিমবঙ্গ বদ্ধভূমি হয় না। সেগুলো নাকি সব থাকে জনগনের রোষ! অথচ ভাঙরে মানুষ যখন তিতিবিরক্ত হয়ে, অথবা মঙলকোট-এ প্রতিরোধ পাঁচিল গড়ে তোলেন, বা মেদিনিপুর-এ একজন দুজন মরলে, তখন তা হয়ে যায় বদ্ধভূমি।
এক কথায়, ফ্যাসিবাদের এই পুনরুত্থানের সময়, ফ্যসিবাদ মোকাবিলার দক্ষ জ়েনারেল- সুভাষের চলে যাওয়াটা শুধু ক্ষতিকারক নয়, অন্যায় হয়েছে। অন্যায় বলছি, কারন- দিল্লী থেকে ‘কেমো’ নিয়ে ফিরে আসার পর, নেতাজি ইন্ডোর ষ্টেডিয়াম-এ – কতগুলো গণতন্ত্রিক জন্তু জানোয়ারদের সাথে বৈঠকে পাঠানোটা পার্টীর অন্যায় হয়েছে। সেদিনই রমলা কে জিগ্যেস করেছিলাম ‘ এটা তুই কি করে allow করলি?’ ওখানে কোন আলোচনা হয়নি। সুপরিকল্পিত ভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। যেটা ওর ‘কেমো’ নেওয়া শরীর আর সহ্য করতে পারেনি। একে বলে গণতান্ত্রীক পদ্ধতি। মিটিং থেকে ফিরেই ও অসুস্থ হয়ে পরে। খুব বেদনা দায়ক। আজ মনে হয়, সেদিন যদি আর একটু জোর দিয়ে ওকে ওই সব গণতান্ত্রীক জন্তু জানোয়ারদের সাথে, যাদের কেউ সাংসদ, কেউ বিধায়ক, তাদের সাথে বৈঠকে যাওয়া থেকে আটকাতে পারতাম, তা হ’লে হয়তো আজ ওকে হারাতে হত না। মৃত্যুপথ যাত্রী মানুষ এর যন্ত্রণা টা যাদের কাছে বড় নয়, মস্তানি দেখানো টাই বড়।
জ্যোতি বাবুর পর, জননেতা বলতে যদি কাউকে বোঝায়, সে ছিল সুভাষ। তার ভেতর এবং বাইরে কোন অমিল ছিল না। কোন ভন্ডামীর ধার ধারত না। যা মনে করতো, তাই বলতো, এবং সেটাই করার চেষ্টা করতো। সেটা আমাদের পছন্দ হতেও পারে, নাও পারে। কিন্তু সুভাষ ভন্ডামী করে নিজের বিপ্লবীয়ানা বা বামপন্থা কে বজায় রাখার চেষ্টা করতো না।
একটা জিনিষ মানতেই হবে, মনের প্রসারতা- চেয়ারম্যান মাও যেতাকে বলেছেন কমিউনিষ্ট-দের প্রথম গুন, অন্য কি গুন ছিল কি ছিলনা জানিনা, কিন্তু এ ব্যাপারে সে ছিল ঈর্শ্বনীয়।
ওর সাথে অনেক ব্যাপারেই মত পার্থক্য হয়েছে। কিন্তু পারস্পরিক সন্মান সহযগিতা কমেনি কখনও। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে মিটিং শেষে অনেকেই লাল বাতি লাগানো গাড়ীতে চেপে চলে যান। কখনও নামেন না কেউ। এই কদিন আগে, সুভাষ হঠাৎ এসে হাজির। এসে যথারীতি পূরনো ফর্মেই বলেছিল- ‘তোকে আর এই ঘরে এভাবে থাকতে দেব না।’ উত্তরে বলেছিলাম- ‘আমার কেউ ভাল করতে পারবে না।’ সুভাষও পারলো না। চলেই গেল। যেটা বোঝাতে চাইছি, মতাদর্শের পার্থক্য থাকা সত্বেও দলমত নির্বীশেষে সবার পাশে দাঁড়ানোর সাহস, একমাত্র সুভাষই দেখাতে পারত।
সেদিন যাওয়ার আগে ও বলেছিল- ছ’টা মাস যদি বাঁচি, সব দেখবি ঘুরিয়ে দেব। কিন্তু ছ’টা মাস ওকে বাঁচতে দিল না। এটা un natural death! ঠিক যেমন EVM মেশিনের কারচুপি কখনো প্রমান করা যাবে না, এটাও প্রমান করা যাবে না।