আমরা আজকে ভারতবর্ষের বুকে মাওবাদীদের ভুমিকা নিয়ে আলোচনা করছি।
তাই আজকে তাদের ভুমিকা বুঝতে গেলে আমাদের একটু পিছিয়ে যেতে হবে, ভারতবর্ষে মাওবাদীদের কার্যকলাপের ইতিহাসের মধ্যে।
একদম প্রথম থেকেই, ৬০ দশকের শেষের দিকে যে নকশাল আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তারা নিজেদেরকে ভারতবর্ষের প্রকৃত মার্ক্সবাদী বিপ্লবী শক্তি বলে দাবী করতো। তারা বলতো যে তারাই একমাত্র মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী সংগঠন যারা মানুষকে সক্রিয় করে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রশক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করবে এবং ভারতের সর্বহারা শ্রেনীকে সামন্ততন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদী শোষনের হাত থেকে মুক্তি দেবে।
আমরা যখন ভারতের নকশাল আন্দোলনের ৪০ বছরের ইতিহাস দেখি, ভারতবর্ষের বুকে এই ঘটনাসমূহ দেখে অবাক হওয়ার মতন কোন কারন নেই। পৃথিবীর সব দেশেই, যেখানে বামপন্থী আন্দোলন বিদ্যমান এবং গড়ে উঠেছে, সেখানেই অতিবাম নৈরাজ্যবাদী প্রবনতা আত্মপ্রকাশ করেছে। ভারতবর্ষে ৬০ এবং ৭০ দশকে এই ঘটনার অনেক আগেই আন্তর্জাতিক কমিউনিষ্ট আন্দোলনের মধ্যে এই প্রবনতা কে বিশ্লেষন করেছিলেন এবং এই সমস্যার শিকড় খুজে বার করে বলেছিলেন,
‘পুঁজিবাদের বিভৎসতা দেখে একদল পাতি বুর্জোয়া প্রবল উত্তেজনার বশবর্তী, এই নৈরাজ্যবাদের মতন সামাজিক ঘটনাসমূহ সমস্ত দেশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।‘
বিশেষত ভারতের মতন দেশে, যেখানে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে পাতি বুর্জোয়া শ্রেনী আত্মপ্রকাশ করেছে, এই ঘটনা ঘটছে যেখানে এই শ্রেনীর একাংশ উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে কিছু দুঃসাহসিক হিংস্র কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়েছে, এবং এইটাকে বোঝা সবচেয়ে জরুরী। কারন এখন, যখন মাওবাদীদের কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা চলছে, একটা প্রবনতা দেখা যাচ্ছে, ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক আতঙ্কবাদী হামলার ফলস্বরুপ, যে মাওবাদী পার্টি এবং সংগঠনগুলিকে আতঙ্কবাদী বলে ভুষিত করা। কিন্তু এদের ভারতবর্ষের ৪০ বছরের কার্যকলাপের ইতিহাস দেখ্তে হবে,
প্রথমত, এদের রাজনৈতিক আদর্শ কি এবং বিশ্ববীক্ষা কি?
তারা নিজেদের কে মার্ক্সবাদী বলে দাবী করে। মার্ক্সবাদী কাঠামোর মধ্যে তাদের কর্মসূচি ঠিক করে। আর মার্ক্সীয় দৃষ্টিরুপ দিয়ে তারা সমাজ এবং বিশ্বকে দেখে। তাদের লেখালেখি পড়ে আমি যা বুঝেছি, তারা মনে করে যে দক্ষিন এশিয়া এখন এক চরম বৈপ্লবিক পরিস্থিতির সামনে এসে দাড়িয়েছে। দক্ষিন এশিয়ার জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনগুলি শক্তিশালী হয়ে এগিয়ে চলেছে, আর তারা একটি তুলনা টানছে –তারা বলছে যে পশ্চিম এশিয়া হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু, এবং দক্ষিন এশিয়া হচ্ছে কেন্দ্র।
কিন্তু সত্যটা কি? জয়তী ঘোষ সেই কথা এখনই বলেছেন। দক্ষিন এশিয়ায় এই মুহুর্তে কি হচ্ছে? একদিকে পাকিস্তান – সবাই জানে পাকিস্তান হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্থ মিত্র রাষ্ট্র। এই মুহুর্তে সেই রাষ্ট্র আমেরিকার সাহায্য ছাড়া অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতকেও নিজেদের কৌশলগত মিত্র হিসেবে পেয়েছে......তারা আস্তে আস্তে বাংলাদেশের বুকে ঘাটি গড়ে তুলছে, শ্রী লঙ্কায় ঘাটি গড়ে তুলছে। এবং আফঘানিস্তানে সাম্রাজ্যবাদ ন্যাটোর মুখোশ পড়ে যুদ্ধ চালাচ্ছে। কিন্তু এইটা বাদ দিলে, দক্ষিন এশিয়া কি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু এবং এইসব দেশের মানুষ কি তাদের মুৎসুদ্দি শাসক শ্রেনী এবং সাম্রাজ্যবাদকে ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে পড়েছে?
মাওবাদীদের তত্ত্ব এবং রাজনীতির চরিত্র হলো যে তারা বাস্তবতার থেকে অনেক দূরে। তাই তারা যখন পশ্চিম এশিয়ার কথা বলে তখন তারা তালিবানের মতন ধর্মীয় মৌলবাদীদের কে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে নিজেদের কৌশলগত মিত্র বলে মনে করে। পাকিস্থানের সোয়্যাট ভ্যালি, ফাটা, দক্ষিন ওয়াজিরিস্থান এইসব জায়গাকে তারা মনে করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের পীঠস্থান। আর তাই LTTE যখন সামরিক ভাবে পরাস্ত এবং তাদের নেতা প্রভাকরণ যখন মৃত, মাওবাদীরা তাই নিয়ে দুঃখিত। তারা মনে করে দক্ষিন এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে এইটা একটা পরাজয়। এইরকম ভাবে LTTE কে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী বলা, এটা একটা বিকৃত ধারনা। যে LTTE শ্রীলঙ্কায় তামিলদের গনতান্ত্রিক আন্দোলন এবং নিজেদের এলাকায় গনতন্ত্রকে আস্তে আস্তে ধংস করেছে, সেখানে স্বৈরাচারী সামরিক শাসন জারি করেছে, তাদের পরাজয় নিয়ে দুঃখিত মাওবাদীরা.........আর আমরা মনে করি তামিলদের গনতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধির জন্যে এই পরাজয় অত্যন্ত জরুরী ছিল।
তাই ঠিক যেভাবে তাদের বিশ্ববীক্ষা বিকৃত, সেভাবেই ভারতবর্ষে এলে দেখা যাবে তারা সবসময় মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেনীর কথা বলে এসেছে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হলো, তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন হচ্ছে মুৎসদ্দিদের মতন। তারা পাইকারি হারে চীনের কমিউনিষ্ট পার্টি থেকে ধ্যানধারনা ধার করে এসেছে, এমন একটা সময় যখন চীনের পার্টির মধ্যেই প্রবলভাবে গোষ্ঠীবিরোধ দেখা যাচ্ছিল, সেই সময় যাকে মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব বলা হয়ে থাকে। তাদের ধারনার মধ্যেই এইসব গোষ্ঠীবিরোধ এবং শিশুসুলভতার ছাপ দেখা যায়। লিন বিয়াও অনেকদিন হলো মৃত, কিন্তু একদিক দিয়ে ভারতবর্ষে তিনি এখনও জীবিত। নকশালদের দল ভেঙ্গেছে সেই দুটো ভাগে – লিন বিয়াওএর সমর্থনে এবং তার বিরুদ্ধে। এই লিন বিয়াও সমর্থনকারী গোষ্ঠীর একজন নেতা এখন কলকাতায় বাস করেন, তিনি মাওবাদীদের রাজনীতি, অনুশীলন এবং পার্টির সবথেকে বড় সমালোচকদের মধ্যে একজন। কিন্তু এইসব পুরনো এবং বিকৃত ধ্যানধারনা নিয়ে মাওবাদীরা এখনও চলছে।
তার ফল কি হয়েছে। তুমি যখন বলছো যে ভারত একটি আধা-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্তবাদী দেশ, ভারতবর্ষে কি ঘটেছে তমি তা অস্বীকার করছো, ভারতের শ্রেনীবিন্যাস কে অস্বীকার করছো, এই তথ্যটি অস্বীকার করছো যে বিংশ শতাব্দীতে স্বাধীন হওয়া সমস্ত দেশের মধ্যে ভারতে সবচেয়ে শক্তিশালী বুর্জোয়া শ্রেনী আছে। ভারতে যে একটি শক্তিশালী পুঁজীবাদী ভিত্তি এবং রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, সেই রাষ্ট্র কে অস্বীকার করছো তুমি। কৃষিব্যাবস্থায় পুঁজিবাদের বিকাশ কে অস্বীকার করছো। আর তুমি নিজেকে বিপ্লবী ভ্যানগার্ড বলছো, অথচ শ্রমিক শ্রেনী কে অস্বীকার করছো!
তাত্ত্বিক ভাবেও তারা এই শ্রমিক শ্রেনী কে কল্পনা করতে পারছে না কারন ভারতে পুঁজিবাদের এইরুপ বিকাশকে তারা মানছে না। তাদের রাজনৈতিক প্রচার, কর্মকান্ড, অনুশীলন, কোথাও এই শ্রমিক শ্রেনীর স্থান নেই। মাওবাদের ওপর নিজেদের ভিত্তির কথা বলে তারা কৃষকসমাজের কথা বলছে......কিভাবে কৃষকরা বিপ্লবের পথে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এমন কোন জায়গা নেই যেখানে তারা শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছে। আমি এখনকার মাওবাদী দলের কথা বলছি। একমাত্র আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় তারা সক্রিয় এবং সেখানে তারা সফল ভাবে জনভিত্তি গড়ে তুলতে পেরেছে। ছত্তিসগড়, বিহার, ওড়িশার কিছু অংশ এবং বঙ্গের সীমান্তবর্তী ঝারখন্ডের সংলগ্ন তিনটে জেলায় বা মহারাষ্ট্রের গাডচিড়োলির মতন একটা ছোট জায়গায়, যেগুলি আদিবাসী অধ্যুষিত ঘন জঙ্গল বা পাহাড়ে ভরা প্রান্তিক এলাকা। এইসব এলাকাগুলি উন্নয়ন বা যোগাযোগ ব্যাবস্থার দিক দিয়ে প্রচন্ড ভাবে পিছিয়ে পড়ে আছে, এইসব এলাকাগুলিতে কিছু সশস্ত্র স্কোয়াড বা গেরিলা বাহিনী লুকিয়ে থেকে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব। কিন্তু কৃষক এবং শ্রমিকদের নিয়ে বিশাল ভাবে বৈপ্লবিক আন্দোলন.........এটা তাদের ভাবনাচিন্তার বাইরে। তাই তারা শ্রেনীশত্রু কে ক্ষতম করবার সময় কোনরকম তফাৎ করে না, যেই কৌশল ৭০ দশকে নকশালরা অবলম্বন করেছিল, বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের সক্রিয় করতে ব্যার্থ হয়ে, তারা এই নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। এবং তাদের লক্ষ্য হলো সাধারন পুলিশকর্মী, বা কৃষক বা যেকোন রকম সাধারন মানুষ।
বছরের পর বছর ধরে যা হয়েছে, এই ধরনের গোষ্ঠীবাদী রাজনীতিতে, তা হলো, এরা নিজেদের সশস্ত্র স্কোয়াড, বন্দুক বোমা ইত্যাদির ওপর প্রবল ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর আজকে এইসব এলাকায় তারা যেভাবে নিজেদের কার্যকলাপ চালাচ্ছে, ঠিক এইভাবে তারা আগে অন্ধ্রপ্রদেশে এই একই প্রচেষ্টা চালিয়েছে......অন্ধ্র তে রাষ্ট্র এবং পুলিশ বাহিনী সফল ভাবে এদের ঘাঁটি এবং স্কোয়াড গুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে, এরা চুড়ান্ত ভাবে পরাজিত......এইখান থেকে ছত্তিসগড় এবং দন্ডকারন্যে সরে গেছিলো, এবং ওড়িশা, ঝাড়খন্ড এবং মহারাষ্ট্রের কিছু এলাকায়, ঝাড়খন্ড থেকে তারা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় এসে ঢুকেছে।
তারা দাবী করে যে তারা একমাত্র পার্টি যারা শাসকশ্রেনী এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়ছে। সাম্প্রতিক কালের নকশালদের ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে যে ৮০র দশকে তারা মোটামুটি ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। তারপর জনযুদ্ধ গোষ্ঠী (অন্ধ্রতে) এবং মাওবাদী কমিউনিষ্ট কেন্দ্র ২০০৪এ মিলে যাওয়ার পর তাদের ক্ষমতা অনেক বেড়ে গেছে, অস্ত্রভান্ডার, অস্ত্রচালনা, বিস্ফোরক নিয়ে জ্ঞান, এসব দিক দিয়ে। অন্ধ্রতে LTTEর সদস্যদের থেকে তারা অস্ত্রের প্রশিক্ষন পেয়েছে। তারা যে জোরালো দাবী করছে তারা ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, জনগন জাগ্রত এবং বিপ্লব আসন্ন, এই ভাষার ব্যাবহার শুনলেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়েকার কথা মনে পড়ে যায়......এটাই হচ্ছে মাওবাদীদের আদর্শ এবং বিশ্ববীক্ষা।
এবার আসি বেছে বেছে সিপিআইএমের কর্মীদের আক্রমনের কথায়......প্রবীর যেমন আগেই বলেছে......এটা নতুন কোন ব্যাপার নয়। ৭০এর দশকে সিপিআইএমের ওপরে সবচেয়ে বড় আক্রমন নামিয়ে এনেছিল নকশালরা। সেই সময় রাষ্ট্র এবং শাসক শ্রেনীও সিপিআইএমের ওপর ব্যাপক ভাবে হামলা করেছিল। ১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করা হয়, যা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট সরকার আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে। পশ্চিমবঙ্গে তখন কৃষক আন্দোলন এবং জমিবন্টন আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছে, এবং আমাদের দল তাদের জনভিত্তি বাড়িয়ে চলেছে, এইসময় শাসক শ্রেনী হিংস্রভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালো। রাষ্ট্র এবং কংগ্রেস পার্টি সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের দল কে আক্রমন করা শুরু করলো। সিপিআইএম তখন রাজনৈতিক ভাবে পুরো একা হয়ে লড়াই চালাচ্ছে। এইসময় নকশালরা তাদের কৃষক বিপ্লব অসফল হওয়ার পরে শ্রেনীশত্রু খতমের লাইন ধরে, এবং ৭০ থেকে শুরু করে জরুরী অবস্থার শেষ অবধি আমাদের যে ১২০০ কর্মী খুন হয়, তাদের মধ্যে ৩৫০ জন কে নকশালরা খুন করে। ৭০ থেকে ৭১ অবধি এরা এই ৩৫০ জন কে খুন করে, কারন অন্য কোনরকম ভাবে তারা আমাদের দলের জনভিত্তি বৃদ্ধি আটকাতে পারছিল না।
এইটা পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী আন্দোলনের একটি অন্ধকার অধ্যায়, কারন আরেকটি বামপন্থী দলের হাতেই আমারা হিংস্রভাবে আক্রান্ত হচ্ছিলাম। তখন খুব কম দল ছিল যারা সামনে এসে বলতে পারতো যে এইটা বন্ধ হওয়া উচিৎ। একদিকে সর্বভারতীয় পর্যায় ইন্দিরা গান্ধীর কথামতো পুলিশ, আধাসামরিক বাহিনী আর যুব কংগ্রেসের গুন্ডারা আমাদের দলের লোকেদের আক্রমন করছিল, আর অন্যদিকে নকশালদের ব্যাবহার করা হচ্ছিল আমাদের কর্মীদের খুন করবার জন্যে, এবং তারা আগে আমাদের দলে ছিল বলে তারা সফলভাবে এই কাজটি করতে পারছিল। সেই ঘটনার আবার পুনঃরাবৃত্তি হচ্ছে। নির্বাচনে সাময়িক ভাবে পিছিয়ে পড়ার পরেই , সারা পশ্চিমবংগ জুড়ে আমাদের কর্মীদেরকে আক্রান্ত হতে হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, আমাদের পার্টি অফিস ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। এবং আগের মতন এটা করছে তৃনমুল কংগ্রেস এবং তাদের মিত্র মাওবাদীরা।
পশ্চিমবঙ্গে এই আক্রমনগুলো তার মানে শুধু দক্ষিনপন্থীরাই করছে না, অতিবামেরাও করছে। গত সপ্তাহ অবধি শুধু মাওবাদীদের হাতে আমাদের ৭০ জন দলীয় কর্মী মারা গেছে। এইটা ঘটেছে মেদিনীপুর জেলা এবং সংলগ্ন বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়া জেলায়। মাওবাদীরা এই নিয়ে কোনরকম দ্বিমত দেখায় না, গতবছর নভেম্বর মাসে তারা মূখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য কে খুন করবার চেষ্টা চালিয়েছিল, এবং তারা গর্বের সাথে ঘোষনা করেছে, ‘আমারা মূখ্যমন্ত্রী কে লক্ষ্য করেই আক্রমন চালিয়েছিলাম, এবং ভবিষ্যতেও এরকম আক্রমন চালাবো......’ এবং সেইখান থেকেই লালগড়ে ঝামেলার সুত্রপাত যা এখনো চলছে। দীর্ঘ ৬ মাস ধরে পুলিশ এদের সাথে কোনরকম সংঘর্ষে যায়নি, এই ব্যাপারটার সুবিধে নেয় তারা। পুলিশ মুখোমুখি সংঘর্ষে গেলে এরা সামনে মহিলা আর শিশুদের রেখে পেছন থেকে অস্ত্র নিয়ে আক্রমন চালাতো, নন্দীগ্রামের মতন, এবং আক্রমনের হাত থেকে বাচতে পুলিশকেও গুলি চালাতে হতো, যা কাম্য নয়। এবং এর সুযোগ নিয়ে তারা কিছু জঙ্গলের এলাকায় এবং পঞ্চায়েত এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে ফেলে।
মাওবাদীরা দাবি করেছে যে সাম্প্রতিক নির্বাচনে তাদের নির্বাচন বয়কট করবার ডাকে জনগন ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছে। তারা বলছে যেসব জায়গায় তারা সক্রিয় সেখানে এই বয়কট কাজ করেছে। তাহলে লালগড় যেই কেন্দ্রে অবস্থিত সেই ঝাড়্গ্রামে কি হলো? সিপিআইএম এবার অনেক সিট হারিয়েছে, কিন্তু এই সিটে সিপিআইএম সবথেকে বেশী ব্যাবধানে জিতেছে। আর এই নির্বাচনে, যেখানে আমাদের বিশ্লেষন দেখাচ্ছে যে যদিও আমরা গ্রামের দরিদ্রদের মধ্যে শহরের মধ্যবিত্তদের মধ্যে আংশিক ভাবে জনভিত্তি হা্রিয়েছি, তবুও আদিবাসীদের মধ্যে আমাদের প্রতি সমর্থন বজায় থেকেছে......তারা আমাদের সাথেই আছে......ঝাড়গ্রাম এবং অন্যান্য জায়গায়। ঝাড়্গ্রামে যেখানে মাওবাদীরা সক্রিয়, সেখানে ৬৫% ভোটদান হয়েছে, এবং সিপিআইএম বিশাল ব্যাবধানে জিতেছে। তাহলে কি প্রমান হয়? এইরা কিছু জায়গায় জনগন কে বন্দুক নিয়ে ভয় দেখিয়ে ভোট দিতে দেয় না, কিন্তু সাধারন মানুষ নিজের থেকে এদের নির্বাচন বয়কটের ডাকে কখনই সাড়া দেয় না।
আমাদের এটাও দেখতে হবে যে সেই সেই অঞ্চলগুলিতে কি হয়, যে যে জায়গায় তারা সক্রিয় আছে। আমাদের সময়ে, যখন নকশাল-আন্দোলন শুরু হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে নকশালবাড়ি সেই জায়গা নয় যেখানে কোনো বৃহৎ গণ-আন্দোলন শুরু হয়েছিল। একমাত্র জায়গা যেখানে তাদের আন্দোলন সত্যিই জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং যেখানে তারা মানুষকে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই আদিবাসী এবং একাংশ চাষীও, সচল করতে পারে তা হ'ল অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলাম জেলা। শ্রীকাকুলাম জেলা ও উড়িষ্যা সংলগ্ন অন্ধ্রের পাহাড়ী এলাকা ছিল এই আন্দোলনের ভিত্তিভূমি। ১০ বছর আগে আমি সেখানে গিয়েছিলাম এবং দেখেছিলাম যে কোনো আন্দোলন আর সেখানে অবশিষ্ট নেই। বারবার এটাই হয়ে এসেছে। রাষ্ট্র কর্তৃক এই আন্দোলন দমিত হয়, আন্দোলনকারী সমস্ত নেতা বন্দী হয়। ভেমবাটু সত্যনারায়ণ, আদিবাতলা কৈলাশম প্রমুখ স্কুল-শিক্ষকরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আন্দোলনের একমাত্র নেতা যিনি বেঁচে আছেন সেই চৌধুরী তেজেস্বরা রাও এখন আমাদের পার্টির জেলা কমিটির সদস্য। "আমরা ভুল করেছিলাম" বলেছিলেন তিনি। এটি এমন একটি জায়গা, যা বুর্জোয়া পার্টিগুলির ক্রীড়াক্ষেত্র এবং পূর্বের মতোই আদিবাসী মানুষের শোষিত হওয়ার জায়গা, যা বারংবার দেখা দেবে ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, গাডচোলিতে, কারণ ভারতীয় রাষ্ট্র পুলিশ-হত্যা, পুলিশের গাড়িতে বিষ্ফোরণ ঘটানোর মতো প্ররোচনামূলক হিংসার বিপরীতে একইভাবে নিশ্চিত করবে হিংস্র-ভয়াবহ দমনক্রিয়াকে। এবং যখন এমন দমনক্রিয়ার প্রয়োগ হবে, আমরা দেখতে পাবো আদিবাসী মানুষের আরও বহুগুণ পিছিয়ে পড়ার ঘটনা; কারণ, এই মানুষগুলি তারপর বহুকাল ধরেই আর তাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, পারবে না তাদের দাবীগুলি নিয়ে লড়াই করতে। তাহলে দেখাই যাচ্ছে যে, এই হিংসা এবং তার দ্বারা প্ররোচিত ও আমন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন-এর চক্রে পড়ে ফলাফল আদতে আরও খারাপ দিকে যাচ্ছে..আদিবাসী মানুষেরা আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিক্ষেপিত হচ্ছেন।
আমি এইদিকেও আলোকপাত করতে চাই যে, ভারত সরকার - কেন্দ্র এবং আমাদের শাসকশ্রেণী এই বিষয়টি নিয়ে ঠিক কি ভাবছে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গীই বা কি। যখন লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে এবং মুম্বই সন্ত্রাসবাদী হামলার পরবর্তী সময়ে তারা ইউএলপিএ আইন সংশোধন করতে চেয়ে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছিলেন, তাতে আমরাও উপস্থিত ছিলাম। আমরা সেখানে জানিয়েছিলাম সন্ত্রাস-বিরোধী এইসব আইনের অভিজ্ঞতার কথা। আমরা জানি, এইসব আইন যত কড়া হবে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে বেশি বেশি করে নির্দোষ মানুষ, বিশেষতঃ মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এর ফাঁদে পড়বেন এবং জেলে বন্দী হবেন, এবং তাদের পক্ষে ছ'মাস থেকে এক বছরের আগে জেল থেকে মুক্তি পাওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়বে। তাই আমরা বলেছিলাম যে, এই আইন আমরা সমর্থন করতে পারি না। এখন, যদি এই ধারণা নিয়ে এগোনো হয় যে, মাওবাদীরা একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, তাহলে এদের মোকাবিলা সেইভাবেই করা হবে, যেমনটা করা হয় এল.ই.টি., জে.ই.এম. অথবা হুজির ক্ষেত্রে, যারা কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদ দ্বারা চালিত এবং যাদের কোনো আলাদা কর্মসূচী নেই, নেই কোনো পৃথক রাজনৈতিক মঞ্চ। তারা কেবল সন্ত্রাসবাদী কাজেরই সংগঠক এবং সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপের লক্ষ্য খুঁজে বেড়ায় ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করে।
তাই, মাওবাদীদের বিরুদ্ধে এই প্রকার আইন গ্রহণ করার চেষ্টা হ'লে, আমরা তাতে সহমত নই। আমাদের মতে, মাওবাদীদের মোকাবিলা করতে হবে রাজনৈতিকভাবে, মতাদর্শগতভাবে এবং সাংগঠনিকভাবে। যখন তারা গাড়ি-বিষ্ফোরণ ঘটাবে, ট্রেন আক্রমণ করবে অথবা সাধারণ মানুষ খুন করবে সেই সমস্ত ক্ষেত্রে তাদের হিংসাত্মক ঘটনা থামাতে, প্রতিরোধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবশ্যই নিতে হবে। হ্যাঁ। পুলিশকে, সুরক্ষাবলকে ব্যবহারও করতে হবে। কিন্তু মাওবাদীদের কার্যকলাপকে কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ হিসেবে দেখে এর মোকাবিলা করা যাবে না। সেইকারণেই আমরা এই আইনের প্রতি আমাদের অনাস্থা ব্যক্ত করেছিলাম। ভারত সরকার মাওবাদীদের ইউ.এল.পি.এ. আইনের আওতাভুক্ত করলেন এবং তাদের বেআইনি ঘোষণা করলেন। মাওবাদীরা অনেক আগে থেকেই অন্ধ্রপ্রদেশে বেআইনি ঘোষিত হয়ে আছে, তারা ইতিমধ্যেই বেআইনি ও গুপ্ত-ভাবে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে, নতুন করে বেআইনি ঘোষণা করে তাই তাদের কার্যকলাপ আদপেই থামানো যাবে না, এটা প্রথমেই মনে রাখা দরকার।
দ্বিতীয়ত, সরকার সম্ভবতঃ উপলব্ধি করেছে যে আদিবাসী মানুষদের প্রতি সুবিচার করতে তারা ব্যর্থ, এবং মৌলিক পদক্ষেপগুলি, যথা - আদিবাসীদের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং এইসব প্রান্তিক অঞ্চলগুলির উন্নয়নের ব্যবস্থা আদৌ নেওয়া হয়নি, যা কিনা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মাত্র দু'দিন আগেই, প্রধানমন্ত্রী দিল্লীতে সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে একটি আলোচনাসভার ডাক দেন, আদিবাসীদের জন্য 'ফরেস্ট ট্রাইবাল (ল্যান্ড) অ্যাক্ট' আইনের প্রয়োগ নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে, যা মূলতঃ আমাদের(বামপন্থীদের) দেওয়া ক্রমাগত চাপের ফলে গ্রহণ করা হয়েছে। তারা এই পাস করতে চান নি। এই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন যে, আমাদেরকে আদিবাসী মানুষদের শক্তিশালী জন্য কাজ করতে হবে এবং তাদের গুরুতর সমস্যার প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। এবং সংশয় প্রকাশ করে জানতে চেয়েছিলেন, কেন এই আইন গুরুত্বের সাথে প্রযুক্ত হচ্ছে না এবং ভারতের বহু জায়গাতেই কেন এই আইন প্রয়োগ হচ্ছে না। যার উল্লেখ তিনি করেন নি, তা হ'ল বর্তমানে আদিবাসী মানুষদের দুর্গতি ও শোষণের সমস্যার মূলে থাকা বিষয় - কেন্দ্রীয় সরকারের 'খনি ও খনিজপদার্থ নীতি'।
যে খনি ও খনিজপদার্থ নীতির মাধ্যমে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল ও বনাঞ্চলগুলিকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে ভারতীয় ও বৈদেশিক মাইনিং কোম্পানীগুলির লুটের স্বার্থে, তাতে দেখা যাচ্ছে উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়ে কিভাবে উপজাতির মানুষেরা দ্রুত তাদের বাসভূমি থেকে উৎখাত হচ্ছেন, জীবিকা-শূন্য হচ্ছেন, ঐতিহ্যের পারিপার্শ্ব হারাচ্ছেন এবং ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছেন উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে তাদের আত্ম-পরিচিতি হারানোর আশঙ্কায়। প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে কথা বলেন না। তিনি কেবল ক্ষত উপশমের জন্য মলম লাগানোর কথা বলেন। তাই হ্যাঁ, যদি এই সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা প্রকৃতই করতে চান, এবং এই ভারতবর্ষের মাটিতে, তাহলে উপলব্ধি করতে হবে যে নকশালপন্থা ও মাওবাদে কিছু বৈশিষ্ট্য অবশ্যই আছে যার দ্বারা তারা দুর্গত উপজাতিভূক্ত মানুষের মধ্যে একাংশের থেকে আন্তরিক সাড়া পেয়েছে। তাই রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে যে, এই সমস্ত অঞ্চলে অনতিবিলম্বে একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচী তাকে নিতে হবে যা কেন্দ্রীভূত হবে উপজাতিভূক্ত মানুষকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত না হতে দেওয়ার উদ্দেশ্যকে ঘিরে এবং উন্নয়ন অর্থে আদিবাসী মানুষের ঐতিহ্যের বাসভূমিতে থাকার এবং সেখানে কাজ খুঁজে নেওয়ার অধিকারকে সুরক্ষিত করা বোঝাবে। তাদের নিজস্ব ধারার জীবিকাকেও সুরক্ষিত রাখতে হবে, তাদের মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা, যা কিনা একটি রাষ্ট্র তার অধিবাসীদের দিয়ে থাকে, যেমন - রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা দানের পাশাপাশি। এই দায়িত্বই ভারতীয় রাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় সরকারের নেওয়া উচিত।
এবং দ্বিতীয় বিষয়টি হ'ল রাষ্ট্রকে এটা গ্রহণ করতে হবে যে, যে নীতিগুলি তারা প্রয়োগ করছে, মাওবাদীরা তার একটি দিক সম্পর্কে মূল্যায়ণে সঠিক। নয়া উদারনৈতিক পদক্ষেপ এই অঞ্চলগুলিকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং এইসব অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছে। রাষ্ট্রকে এই নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। যদি তা না হয়, এই সমস্যা কোনোদিনও মিটবে না। এবং রাষ্ট্র এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করবে পাশবিক দমন-পীড়নের নীতি গ্রহণ করে, যা মাওবাদীদের আদৌ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে যে তারা বিশাল সংখ্যক আধাসামরিক বাহিনী পাঠাবে, সেনা নামাবে না, কিন্তু পাঠাবে সি.আর.পি.এফ., বি.এস.এফ. অথবা অন্যান্য আধাসামরিক বাহিনীকে।
এখন আমরা জানি মাওবাদীরা কিভাবে কার্যকলাপ চালায় এবং কিভাবে তারা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এতোদিন ধরে। তারা দুর্গম অরণ্যে থাকে, ঝটিকা আক্রমণ ও দ্রুত আক্রমণস্থল থেকে পলায়ন - এই কৌশল অবলম্বন করে। তারা আধাসামরিক বাহিনীর সাথে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হবে না, কারণ তারা জানে সেভাবে লড়তে গেলে তারা সহজেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু যারা আধাসামরিক বাহিনীর তোপের মুখে পড়বে তারা হ'ল সেইসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যেখানে এই মাওবাদীরা তাদের কার্যকলাপ চালায় এবং স্বাভাবিকভাবেই বাইরে থেকে আসা আধাসামরিক বাহিনী শত্রু-মিত্র তফাৎ করতে পারবে না, পারবে না মাওবাদী ও মাওবাদীদের সাথে সম্পর্কহীন উপজাতির মানুষের মধ্যে পার্থক্য করতে। ফলে, সেখানকার সকল সাধারণ মানুষই দমন-পীড়নের কবলে পড়বেন। এই ধরণের অভিযানের অন্তিম পরিণতিতে ঠিক এই ঘটনাই ঘটে। রাষ্ট্র এটা করবেই, কারণ মাওবাদীরাও ঠিক সেভাবেই তাকে প্ররোচিত করছে এই দমন-পীড়ন চালাতে। যখন কেউ সতেরো জন পুলিশকর্মীকে একনিমেষে হত্যা করবে, যখন গোটা পুলিশ-ফাঁড়িতে হত্যালীলা চালাবে, যখন কেউ আক্রমণ ও অপহরণ করবে এতো সংখ্যক ট্রেনকে( রাজধানীর এক্সপ্রেসের ঘটনা তো কিছুই নয়)। ওরা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, সংকেত-ব্যবস্থার যন্ত্রপাতিকেও রেহাই দেয়নি, স্কুল আক্রমণ করেছে, এবং নিদর্শন স্থাপনের উদ্দেশ্যে তারা নির্বিচারে মানুষকেও খুন করে। যদি কেউ তাদের লিখিত বার্তা(communique) পড়েন, দেখবেন যে তারা সগৌরবে ঘোষণা করছে যে তারা এতো মানুষকে হত্যা করেছে। এবং তারা কেবলমাত্র সিপিআই(এম) কর্মীদেরকেই খুন করেনি, উপরন্তু আরও বহু রাজনৈতিক দলের কর্মীকেও খুন করেছে ঝাড়খণ্ড, বিহার ও ছত্তিশগড়ে। কিন্তু সিপিআই(এম)-এর ওপর তাদের একটি বিশেষ রাগ আছে। শেষ চার সপ্তাহে, পশ্চিমবঙ্গ বাদে, এইসব উপজাতি এলাকায় খুব সামান্যই রয়েছে আমাদের অস্তিত্ব, কিন্তু যেখানে যেখানে আমরা উপস্থিত যেমন - ছত্তিশগড়ের কালিক্ষেত, সেখানেও ওরা আমাদের লোকাল কমিটির এক সম্পাদককে খুন করেছে। সুন্দরগড়, যেটি ওইসব অঞ্চলের মধ্যে আমাদের একটি ঘাটি হিসেবে পরিচিত, সেখানেও ওরা আমাদের পার্টি অফিস ধ্বংস করেছে, সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় পার্টি অফিসে কেউ উপস্থিত ছিলেন না। তিন কি চার সপ্তাহ আগে ওরা অন্ধ্রপ্রদেশে আমাদের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় কমরেডকে হত্যা করেছে। ওরা আমাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে, কারণ আমরা পুলিশের মতো নই। সংসদীয় শক্তির মতোও নই। কারণ আমরা যেখানে আছি, সেখানে যদি ওরা থাকে, আমরা ওদের মোকাবিলা করি রাজনৈতিকভাবে। এবং সেটা মাওবাদীরা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। এবং আমরা কিভাবে ওদের মোকাবিলা করি? বন্দুক দিয়ে নয়। পশ্চিমবঙ্গে যদি আমরা তাই করতাম তাহলে কোনো মাওবাদী আর অবশিষ্ট থাকতো না। কিন্তু আমরা তা করতে পারি না। আমরা একটি সরকার চালাচ্ছি, আমাদের একটি নীতি আছে এবং আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে সেই সরকারের পালনীয় কাজের দিকে। কিন্তু যেখানেই আমরা অস্তিত্বশালী, আদর্শগতভাবে, সংগঠনগতভাবে ও রাজনৈতিকভাবে আমরা ওদেরকে চ্যালেঞ্জ করি। আমরা মানুষকে সচল করি এবং বলি মাওবাদীদের পথ সঠিক পথ নয়। মাওবাদীরা মনে করে যে, সিপিআই(এম)-এর সংহার-সাধনই বুঝি তাদের অগ্রসর হওয়ার পথ কাঁটামুক্ত করবে। এই কারণেই যদি পার্টির সামান্যতমও বা দুর্বল অস্তিত্ব থাকে ওইসব এলাকায়, তারা আমাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে এবং আমাদের হত্যা করবে। এটাই এখন বাস্তব। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, রাষ্ট্র যখন সুরক্ষাবল পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেবে, ওদের বিপুল বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যাবে।
১৯৮০-র দশকে, আমি বেশ কিছুটা সময় ধরে নকশালদের সম্পর্কে গভীরভাবে অধ্যয়নের কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম। আমি লিখেছিলাম যে ১৯৮৫-তে নকশালপন্থী পার্টি সংগঠন বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না; চব্বিশটি গোষ্ঠীতে তারা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল এবং আমি অনেক খেটে সেই গোষ্ঠীগুলির চরিত্র বিশ্লেষণ করে ব্যাখ্যা করি, তাদের সাথে কি ঘটেছিল। আমি বলেছিলাম যে তারা আবার কোনো না কোনো রূপে প্রত্যাবর্তন করবে। ভাববেন না এখানেই ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেল। কারণ, আমাদের দেশে অতিবাম রোমহর্ষকতার চিরকাল কিছু আবেদন রয়েছে। কারণ, এটি খুব সহজ একটি রাস্তা। বিপ্লব আসবে না কিন্তু অন্ততঃপক্ষে বিপ্লবে যাওয়ার শর্টকাট রাস্তাটা তারা দেখাতে উদগ্রীব। এবং উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল বাদে, সমাজের একমাত্র যে অংশ থেকে তাদের কিছুটা সহানুভূতি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা হ'ল শহরের বুদ্ধিজীবীমহল। যে কোনো শহরে যান, কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী এমন পাবেন, যারা হয় তাদের সক্রিয় সমর্থক নয়তো বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাঁরা বলবেন, যতই হোক...ওরা তো গরীব মানুষের জন্য লড়ছে। যতই হোক...ওরা আর কি-ই বা করতে পারে...শোষণ এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়া ছাড়া...এবং তাঁরা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মাওবাদীদের কাজের পক্ষেই যুক্তি সাজাবেন। বুদ্ধিজীবীরা ছাড়াও এই কাজটি করে আসছে বিগত প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে অস্তিত্ববান বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন, মাওবাদীদের অধিকার-রক্ষাই যাদের আগ্রহের মূল বিষয়বস্তু। মাওবাদীদের একটি রোমান্টিক ধারণা অবশ্যই আছে এবং তা মিডিয়াতেও প্রতিফলিত হতে আপনারা দেখবেন। তাই যেসব অঞ্চলে মাওবাদীরা কার্যকলাপ চালায় শুধুমাত্র সেইসব অঞ্চলেই রাজনৈতিক-মতাদর্শিক সংগ্রাম চালালে হবে না, যদিও যেখানে যেখানে তা সম্ভব আমরা তা করে যাবো, বর্তমান ভারতে মাওবাদের রাজনৈতিক-মতাদর্শিক চিত্রটি কি তা নিয়ে শহরের বুদ্ধিজীবী মহলের কাছেও যেতে হবে, তাদের সাথে আলোচনা করতে হবে এবং এ ব্যাপারে তাদের দৃষ্টি-আকর্ষণ করে যেতে হবে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে আমরা একই ঘটনা লক্ষ্য করছি। সত্তরের গোড়ার দিকেও নকশালরা পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীমহলে এমন সমর্থকদের পেয়েছিল...একই ঘটনা সেইসময়েও ঘটেছিল। নকশালপন্থার ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করতে অনেক চলচ্চিত্রও সেসময় তৈরী হয়েছিল।
আজকেও পশ্চিমবঙ্গে আমরা বিগত দু'বছর ধরে দেখলাম, বেশি বেশি করে বামমনোভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবীরা অতিবামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। কিন্তু একটি ব্যাপার ঘটছে, যা তাঁদের এই পথে এগোনোর কাজকে আরও বেশি বেশি করে কঠিন করে তুলছে এবং অনেকে পিছিয়ে আসতেও বাধ্য হচ্ছেন, তা হ'ল মাওবাদীদের রাজ্য নেতার দূরদর্শনে ঘোষণা, যে তিনি মমতা ব্যানার্জীকে পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। এবং পাশাপাশি তিনি এটাও ব্যাখ্যা করছেন কিভাবে তারা নন্দীগ্রাম থেকে মার্কসবাদীদের বিতাড়ণ করতে তৃণমূলকে সাহায্য করেছেন এবং লালগড়ে সমস্যায় পড়ে কিভাবে তারা তৃণমূলের সাহায্য প্রত্যাশা করছেন। আর তৃণমূল কংগ্রেসও তাদের সাহায্য করতে কোনো চেষ্টাই বাকী রাখছে না। একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী তো খোলাখুলিই বলছেন, কেন আপনারা ওদের বিরুদ্ধে পুলিশ পাঠাচ্ছেন? কেন আপনারা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন? এবং এখন যখন মাওবাদী-তৃণমূল যোগ-সাজোশের ঘটনা সামনে চলে আসছে, তিনি একধাপ পিছিয়ে বলছেন, মাওবাদী ও মার্কসবাদীদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই, তারা নাকি একই মুদ্রার এ পিঠ - ও পিঠ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সবাই জানেন যে, সেখানে তৃণমূল এবং মাওবাদীদের মধ্যে যৌথ-উদ্যোগ বর্তমান এবং তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুই হ'ল সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্ট। তাই মনে করি, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে এই বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে মুখর হওয়া জরুরী। অর্থাৎ যে ভূমিকা তারা পালন করছে...সিপিআই(এম)-এর সাথে কেউ একমত না হতেই পারেন...কিন্তু প্রত্যেকেই জানেন যে পশ্চিমবঙ্গই বামপন্থীদের সর্বাধিক শক্তিশালী ঘাঁটি। বর্তমানে তা নাও হতে পারে...কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, এখানকার বামভিত্তিকে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করতেই তারা এখানে উগ্র-দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত ধরেছে। আমি মনে করি, এই বিষয়টিকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া বিশেষভাবে দরকার।
পশ্চিমবঙ্গে এখন বামপন্থীদের পক্ষে কঠিন সময় চলেছে...যখন তারা কর্মীদের হারাচ্ছেন পরিকল্পিত খুন এবং হিংসার ফলে, যা চালিত হচ্ছে একটি একক লক্ষ্য নিয়ে, যেন তারা হতোদ্যম হয়ে পিছিয়ে যান, মানুষের মাঝে কাজ করা বন্ধ করে দেন। আমরা তা করতে পারবো না, এবং আমাদের আত্ম-বলিদান দিয়ে যেতে হবে, গুরুতর ক্ষতিস্বীকারও করতে হবে; কিন্তু আমরা আত্মবিশ্বাসী। আমরা এর থেকেও খারাপ সময় দেখেছি...যেমন আমি ১৯৭০-৭১ -এর মাঝের সময়ের কথা বললাম, যখন কোনো শরিক দলই আমাদের পাশে ছিল না, সময়টা ছিল অন্যতম এক কঠিন মুহূর্ত যার সম্মুখীন আমাদের পার্টি কোনওকালে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য বামদলগুলি তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সিপিআই(এম) যখন বেকায়দায় তখন তা নিয়ে তাদের করণীয় কিছু নেই, সিপিআই(এম)-কে একাই বরং এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে দাও..আমাদের বহুদিন লেগেছিল তাদেরকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। তাদের কেউ কেউ বলতে আরম্ভ করেছিলেন যে তারা বিপথে চালিত হয়ে পড়া বিপ্লবী এবং তাদের সাহায্য এবং আইনী সহযোগিতা দেওয়া জরুরি যদি তারা গ্রেপ্তার হন, ইত্যাদি...কিন্তু অন্যান্য পার্টিগুলি তা করেছিল, আজ কিন্তু তারা আর সে কথা আর বলছে না তাদের অভিজ্ঞতাজনিত কারণে। আমরা এই সংকট কাটিয়ে উঠবোই। কিন্তু এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গেরই প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন এটাই যে, আমরা যদি সারাদেশে একটি প্রকৃত বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়তে চাই, কারণ মাওবাদীরা কখনই নয়া-উদারনীতির বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম হবে না, সক্ষম হবে না শাসকশ্রেণীর বৈষম্য-সৃষ্টিকারী নীতি এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে তাদের কৌশলগত আঁতাত(strategic alliance)-এর বিরুদ্ধে লড়তে, এই ইস্যুগুলির একটি নিয়েও মাওবাদীদের দেখা যায় না মানুষকে চালিত করার কাজে লিপ্ত থাকতে, এইসব নীতিগুলির বিরোধিতা করে বিকল্প নীতি মানুষের সামনে তুলে ধরতে।
তাই সর্বভারতীয় স্তরে যদি আমাদের একটি প্রকৃত বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তুলতে হয়, তাহলে আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে যে, মাওবাদীরা যেন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং এই উগ্র-বামবিপ্লবী-বুলি আওড়ানো রাজনীতি যেন রাজনৈতিক-দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয়। এবং তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক, সাংগঠনিক এবং সতাদর্শগতভাবেই করা সম্ভব যদি সেই লড়াইটা লড়তে হয়। এবং একই সময়ে এই বিষয়েও পরিষ্কার থাকা দরকার যে মাওবাদীদের নৈরাজ্য সৃষ্টির হিংসাকে কোনোভাবেই যুক্তিগ্রাহ্যতা দেওয়া বা ছোটো করে দেখা যাবে না।
ধন্যবাদ।