Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

সেদিন থেকে আজ - স্বপন দাস

১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দেহরক্ষীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। সপ্তাহব্যাপী দূরদর্শনে তাঁর চিতার আগুন জ্বালিয়ে রাখা হোলো-বার বার সে আগুন দেখানো হোলো সারা দেশ জুড়ে। ভাবাবেগের স্রোতে নির্বাচনে অভাবনীয় ফল পেল কংগ্রেস দল।

জয়ী  হলেন ইস্ট জর্জিয়া ইঊনির্ভাসিটি-র কৃতী ছাত্রী-ডঃ মমতা ব্যানার্জী। 

 

১৯৮৫ সালের মার্চে ধরা পরে জালিয়াতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারীভাবে জানানো হয় আমেরিকায় ঐ নামে কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। 

 

১৯৮৬ সালের ১২-ই জানুয়ারী। যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করতে এবং নিজের লোকদের টাকা পাইয়ে দিতে বেহালায় শুরু হয় ঋণমেলা। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মসূচি হলেও মেলা পরিচালনার ভার মমতা ব্যানার্জীর হাতে। তিনি প্রচার করলেন হাজার হাজার মানুষকে কোটি কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়া হবে। সেই মতো কংগ্রেসের তরফ থেকে পাড়ায় পাড়ায় জাল ফর্ম বিলি করা হয়। যদিও স্টেট ব্যাঙ্কের বেহালা শাখা থেকে সীমিত পরিমাণ টাকা সীমিত সংখ্যক যুবক-যুবতীকে দেওয়ার কথা। প্রচারের ফাঁদে পড়ে নির্দিষ্ট দিনে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। বেগতিক দেখে কুমারী ব্যানার্জী পালাবার পথ খুঁজছেন। ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়ে চোট পেলেন এক মহিলা। মূহুর্তের মধ্যে রটে গেল মহিলাকে মারা হয়েছে। কে মারলো, কেন মারলো জানা নেই। মেলা থেকে পালিয়ে দলবলসহ তিনি বেহালা থানা ঘেরাও করলেন। আবার নতুন করে রটে গেল "মমতা প্রহৃত"। চুলোয় গেল ঋণমেলা। হারিয়ে গেলেন সেই মহিলা। প্রচারের আলোয় 'শুধুই মমতা' 

 

১৯৮৮-আবারও বেহালা। বুড়ো শিবতলার 'গরিব ভান্ডার'-এর ভেজাল তেল খেয়ে বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে আসরে নামলেন একদিকে সুব্রত মুখার্জি অপর দিকে মমতা ব্যানার্জী। বিদ্যাসাগর হাসপাতালে অসুস্থদের দেখার নাম করে ভাঙচুর করে সুব্রত বাহিনী।  পরের দিন কাগজে হেড লাইনে সে খবর দেখে- তাকে টেক্কা দিতে তৎকালীন ত্রিপুরার কুখ্যাত মন্ত্রী সুধীর মজুমদারকে সাথে নিয়ে মমতা যান বিদ্যাসাগর হাসপাতালে। কি হয়েছিল সে কথা যেমন পরের দিন কাগজে বেরিয়ে ছিল সাথে এ মন্তব্যও ছিল "আশ্চর্য, সুধীরদাকে নিয়ে এলাম, আর একটাও কাগজের লোক আসেনি"। পরের দিন কাগজে ফলাও করে তৈরী খবর ছাপা হোলো। 

 

মেটাল বক্স- আসরে নামলেন কুমারী ব্যানার্জী। খোদ দিল্লীতে শুরু করলেন চটকদারি রাজনীতি। গলায় পোস্টার ঝুলিয়ে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী ভেঙ্গল রাও-এর খালি ঘরের সামনে এক ঘন্টার প্রতীকি অনশনে বসলেন। মন্ত্রী বৈঠক ছেড়ে ছুটে এলেন এবং মেটাল বক্স খোলার প্রতিশ্রুতি দিলেন। কাগজে মমতা ব্যানার্জীর বড় উজ্জ্বল ছবি ছাপানোর চাহিদা পূর্ণ হলেও মেটাল বক্স-এর দরজা খুলল না। 

 

১৯৮৯- লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্রে পরাজিত হলেন কুমারী মমতা ব্যানার্জী। তার পরিচয় হবে শুধু প্রাক্তন সাংসদ বা শুধুই যুব নেত্রী! প্রচারে থাকতে চাওয়া এহেন মানুষের পক্ষে তা ছিল বড়ই কঠিন। অতএব সুযোগের অপেক্ষা।

 

১৯৯০- ১লা  আগস্ট। বাস ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদের নামে চলল কংগ্রেসী তান্ডব। পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ৩৭টি সরকারী বাস ভেঙ্গে চুরমার করাই নয়-বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে গিয়ে মারাত্মক আহত হন ১২জন পুলিশ কর্মী। তবে, বিশেষ নজর কাড়লো তারাতলার  দায়িত্বে থাকা যুব নেত্রী মমতা ব্যানার্জী। তার বেপরোয়া তান্ডব ঠেকাতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন পদস্থ পুলিশ অফিসার দেবেন বিশ্বাস। তিনি আলোচনা করতে চাইলে যুব নেত্রী রাজি হন। কিন্তু শুকনো আলোচনায় প্রচারের আলোয় আসা যাবে না। তাই শুধু চমকের রাজনীতিতে বিশ্বাসী কুমারী ব্যানার্জীর নির্দেশে চেষ্টা হলো কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারকে কাপড় পড়ানোর। সে চেষ্ঠা ব্যর্থ হওয়ায় নেত্রী নিজে হাতে আলকাতরা মাখিয়ে দিলেন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের মুখে। নিমেষে শুরু হোলো তান্ডবের দ্বিতীয় পর্ব। পরের দিন বাজারী সংবাদ মাধ্যম তাকে 'লড়াকু নেত্রী'-র শিরোপা দিল।

 

১৯৯০-৩রা আগাস্ট। 'লড়াকু নেত্রী' সদলবলে হাজির হলেন বেহালা থানায়। সোজা ঢুকে পড়েন ওসি-র ঘরে। ওসি-র কলার ধরে তাকে চেয়ার থেকে টেনে ফেলে দিয়ে নিজে বসে পড়েন। সেই শুরু অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় গায়ের জোরে চেয়ার দখলের 'মমতার ক্ষমতা' প্রদর্শন পালা।  

 

১৯৯১- ২রা মে। আসন্ন নির্বাচনের প্রচার কর্মসূচী হিসেবে গার্ডেনরিচ-এর রামনগর লেনে CPI(M) কাউন্সিলর মৃণাল মন্ডলের উপস্থিতিতে দেওয়াল লিখন চলাকালীন সেখানে কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী কুখ্যাত দুষ্কৃতি 'কসমা' সদলবলে হাজির হয়ে তার এলাকায় কেন CPM-এর দেওয়াল লিখছে-এই অপরাধে কাউন্সিলর মৃণাল মন্ডলকে গুলি করতে উদ্যত হয় 'কসমা'

ঙ্কিম আচার্য, শেখর হাজরাসহ আশেপাশের কারখানা থেকে শ্রমিকরা ছুটে আসাতে শূন্যে গুলি চালিয়ে 'কসমা' পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার কিছু পরেই কসমা আক্রমণ করে সি পি আই এম প্রভাবিত ঘোষ বস্তি এলাকায়। ভাঙ্গা হয় 'শিশুকল্যাণ প্রাথমিক স্কুল'। বোমা মারা হয় আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক শ্যামল সুন্দর বেরার বাড়িতে। বোমার আঘাতে মারা যায় সি পি আই এম কর্মী পিঙ্কু দাস ও তরুণ বেরা। গুরুতর আহত হন-অমল চ্যাটার্জী, সীমা চৌধুরী, সনাতন দাস, রবীন মন্ডল সহ বহু সি পি আই এম কর্মী।   

 

৩রা মে ঐ এলাকায় প্রতিবাদে বন্‌ধ ডাকা হয়।  

 

৪ঠা মে আবারও ঐ কসমা ও তার বাহিনী, মুন্সীর খাটালের কাছে মা ও ছোট বোনের সামনে গুলিতে ঝাঁঝড়া করে তুলসী মন্ডল নামে এক যুবককে। 

এতো কিছু করার পর যখন 'কসমা'-র নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের হয়। তখন মমতা ব্যানার্জী পুলিসকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলেন "কসমা-কে গ্রেপ্তার করলে রক্ত-গঙ্গা বয়ে যাবে" 

কেন রক্ত গঙ্গা বয়ে যাবে বোঝা গেল, নির্বাচনের ফলাফলে। নির্বাচনে জয়ী হলেন 'লড়াকু নেত্রী''আমি মন্ত্রী হ'ব নাটকের শুভ মহরত হ'ল।  

 

১৯৯১এর জুলাই মাসে গার্ডেনরিচে খুন হলেন জনৈক শাহজাদা। সদ্য মন্ত্রী তখন কলকাতায়। মওকা বুঝে নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে উপস্থিত হলেন ঘটনাস্থলে। জানা গেল শাহজাদা কংগ্রেস কর্মী ছিলেন তাই সি পি এম তাকে হত্যা করে। শুধু এখানেই থেমে থাকেননি। জ্বালাময়ী ভাষণে নিরাপত্তা কর্মীদের উদ্দেশ্যে বললেন,"চলে যান আপনারা, সি পি এমের হাতে নিরীহ লোক মারা যাবে আর আমরা মন্ত্রীরা বডিগার্ড নিয়ে ঘুরবো তা হতে পারেনা।" পরের দিন সংবাদপত্রের শিরোনামে তিনি।

কিন্তু সত্য বেড়িয়ে পড়লো অচিরেই। জানা গেল কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার ঐ শাহজাদা।   

 

 ২৮শে সেপ্টেম্বর- কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তো কি হয়েছে? কতটা ক্ষমতাশালী তা প্রমাণ  করার সামান্যতম সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নন কুমারী মন্ত্রী। আর সে ক্ষমতা প্রদর্শনের শিকার হতে পারেন  যে কোন মানুষ। সে তিনি যেই হোন। হতে পারেন তিনি আয়কর কমিশনার ইজাঙ বা আয়কর অফিসার ক্ষেত্রমোহন চক্রবর্তী।

তাদের অপরাধ?

ঐ দিন দক্ষিণ কলকাতার ৪৬ নং ম্যুর এভিনিউতে ঐ দুই পদস্থ অফিসার কেন্দ্রীয় পূর্ত দপ্তর ও রাজ্য পুলিশের কর্মীদের সাথে নিয়ে একটি জমি দখল নিতে যান। জমিটি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নামে একটি সংস্থার। প্রচুর পরিমাণে আয়কর বাকি পড়ে থাকায় আদালতের মাধ্যমে আয়কর বিভাগ ঐ জমি কিনে নেয় এবং সেখানে একটি আবসন প্রকল্প বানানোর সিদ্বান্ত নেয়। এজন্য কলকাতা হাইকোর্টের বৈধ কাগজপত্র ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং ও সম্প্রচার মন্ত্রী অজিত পাঁজার চিঠিপত্র নিয়েই জমিটি অধিগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন আয়কর দপ্তরের অফিসাররা। অধিগ্রহণের কাজ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে সদলবলে আসেন কংগ্রেস নেতা পঙ্কজ ব্যানার্জী। বৈধ কাগজপত্র দেখে রণে ভঙ্গ দেন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এরপর সাইরেন বাজিয়ে আসেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। গাড়ি থেকে বেড়িয়ে তার হুংকার ছিল, "কে জমি অধিগ্রহণের অধিকার দিয়েছে?'' ইজাঙ এগিয়ে এসে কিছু বলতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু তিনি মুখ খোলার আগেই তার জামার কলার ধরে গালে চড় বসিয়ে দেন কুমারী মন্ত্রী। ঊর্ধ্বতন অফিসারকে লাঞ্ছিত হতে দেখে এগিয়ে আসেন ক্ষেত্রমোহন চক্রবর্তী। পরিণাম একই। শুধু সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন পারিষদগণ। মন্ত্রী শেষ করতেই সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিল তার  'তান্ডব বাহিনী'

 

১৯৯২-৮ই জুন। বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে উপ-নির্বাচন। ক্ষমতা প্রদর্শনের নমুনা দেখল গোটা এলাকা। সারা দিন ধরে চলল প্ররোচনা ও হুমকি। নেত্রীর অনুগামীদের আক্রমণে ৭-জন পুলিশ কর্মী মারাত্মক জখম হয় এবং পুলিশ বাধ্য হয় গুলি চালাতে। মারা যান এক নিরীহ যুবক। গুলি চালানোর আগে থেকে শেষ পর্যন্ত দূরদর্শন এমনভাবে দেখিয়েছিল, যাতে মনে হয়ে ছিল যে ওখানে গন্ডগোল হবেই এবং তা পুর্ব-পরিকল্পিত। পরে মমতা ব্যানার্জীসহ অনেককে জেরা করে ইউসুফ কমিশন তার রির্পোটে বলে "হাঙ্গামার পরিকল্পনা কুমারী মমতা ব্যানার্জীর নির্দেশে রূপায়িত হয় এবং উপ-নির্বাচনের ২৪ ঘন্টা আগে কসবার কে,এন, সিং রোডে বাহাদুর সেনগুপ্ত নামে একজনের বাড়িতে বসে কুমারী ব্যানার্জী এই পরিকল্পনা করেন।"

স্মরণে থাকতে পারে ঐ দিন নেত্রীর অনুগামীরা গড়িয়াহাটে অপর গোষ্ঠীর এক কংগ্রেসী নেতা সুব্রত মুখার্জীকেও তাড়া করে। ইউসুফ কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সুব্রত মুখার্জ্জী সে সময় বলে ছিলেন-

"আমি সেদিন খুন হয়ে যেতাম" 

 

১৯৯২ মন্ত্রীত্ব যার পায়ের চটি-সম তাকে বাঁধে কে? ব্রিগেডের সমাবেশে ঘোষণা করলেন 'কংগ্রেস দল একটা ভাঁড়', সি.পি.এম-এর মনোরঞ্জনের জন্য এ দলের মন্ত্রীত্বে থাকা যায় না। এবং দিল্লীতে মন্ত্রী সেজে থাকলে বাংলায় কাজ করা যাবে না'-এই বানী শুনিয়ে কুমারী, নরসিমা রাও মন্ত্রীসভা থেকে  পদত্যাগ করলেন। স্মরণে থাকতে পারে-এই সভাতেই প্রথম 'সি পি এম-এর মৃত্যুঘন্টা বাজানোর আয়োজন করা হয়। যদিও সে ঘন্টা বাজার আগেই ভেঙ্গেঁ পরে যায়!

 

একাদশী-র দশা কাটাতে এক বর্ষীয়ান সাংবাদিক যেন ওৎ পেতে ছিলেন। এত দিনে ভগবান মুখ তুলে চাইলেন। পরের দিনের কাগজের 'শিরোনাম' হোলো 'ত্যাগের প্রতীক' মমতা।'

 

বছর শেষ হ'তে চলল অথচ 'ত্যাগের প্রতীক'-এর হাতে পেন্সিল ছাড়া কিছু নেই-তা হয়!

নভেম্বর মাস। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য বি.জে.পি করসেবকরা জড়ো হতে শুরু করেছে। বামপন্থীদের প্রতিবাদে সারা ভারতসহ কলকাতা মুখর। এহেন সময়, কলকাতার জনসবায় অভয় বাণী শোনালেন 'ত্যাগের প্রতীক'-

"অযোধ্যায় ওসব কিছু হবে না। সি.পি.এম মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে।"

এরপর ৬ই ডিসেম্বর কি ঘটলো তা সবার জানা।

 

১৯৯৩-২১শে জুলাই। পুনঃ র্নিলোভী যুব নেত্রী যে কতটা হিংসাশ্রয়ী সেদিন দেখল সারা বাংলা।

তিনিই একমাত্র আগ মার্কা সি.পি.এম. বিরোধী তা প্রমাণ  করার জন্য ইতিমধ্যেই দলে একটা পাল্টা গোষ্ঠী গড়ে তুলেছেন। যদিও মূল লক্ষ্য ছিল সোমেন মিত্র গোষ্ঠীর প্রভাব ঠেকানো। কিন্তু সে তো অন্দর কী বাত। সামনে আনা হোলো প্রদেশ যুব কংগ্রেসের নামে মহাকরণ অবরোধের ডাক। তিনি ঘোষণা করলেন মহাকরণ ঘিরে পাঁচটি জায়গায় যুবরা জমায়েত হবে। ভাষণ শুনবে ও গুটি গুটি পায়ে ঘরে ফিরে যাবে।

১০ লক্ষ (!) মানুষের কেউ ১৪৪ ধারা জারি করা এলাকায় ঢুকবে না।  

সভা শুরু হোলো। নতুন গোষ্ঠীর প্রত্যেক নেতা পুলিস, বামফ্রন্ট সরকার, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এমনকি সোমেন মিত্র-র নামেও উস্কানিমূলক ভাষণ দিতে লাগলেন। যেমন-

(১) শোভনদেব চ্যাটার্জী- "পুলিশ আর কতজন আছে? ২০০/২৫০! আমরা চার-পাঁচ হাজার। চলুন রাইর্টাস দখল করি।"

(২) সত্য বাপুলি- "ওই তো পুলিশ পিছু হঠছে-আপনার এগোতে থাকুন।"  

(৩) মৃগেন মুখার্জী- "আমরা মারতে এসেছি। অভিনয় করতে আসিনি।"

(৪) সুদীপ ব্যানার্জী-"প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের পেটাতে হবে।"

আর স্বয়ং(পুনঃ)যুব নেত্রী?

প্রতিটা জমায়েত পয়েন্ট ঘুরে ঘুরে পুলিশ গুলি চালিয়েছে বলে গুজব রটাতে থাকেন। তখনও গুলি চালানোর মতো কোনো ঘটনা আদৌ ঘটেনি। যখন বোঝা গেল যুবরা জাগছে না তখনই শুরু হোলো পূর্ব পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণ। হাল ধরলেন সৌগত রায়, মদন মিত্র ও স্বয়ং যুব নেত্রী। মহাকরণ অবোরোধের ডাক পালটে হয়ে গেল 'মহাকরণ দখল'

"পুলিশ কম আমরা বেশী। পারবে না আমাদের সাথে"-রেড রোডে পয়েন্টে মদন মিত্রের এই ঘোষণার সাথে সাথেই শুরু হোলো ইঁট,বোতল বৃষ্টি। ছড়িয়ে পড়লো মেয়ো রোড ও চৌরঙ্গীতে। চৌরঙ্গীতে পাইপগান থেকে গুলি ছোঁড়া হ'ল। বোমা পড়ল মহাকরণ লাগোয়া ১৪৪ ধারা জারি করা এলাকায়। পুলিশের গুলির সামনে তাজা যুবকদের এগিয়ে দিয়ে মমতা ব্যানার্জীসহ অন্যান্য নেতারা সরে পড়লেন।

সাধন পান্ডে গাড়ি করে এলেন বিধান সভায়।

শোভনদেব চ্যাটার্জী-প্রেস ক্লাবে।

যুব নেত্রী 'আহত' সেজে প্রথমে এন আর এস-এ ও পরে এক বিশেষ বে-সরকারি নার্সিং হোমে।   

ট্রাম,বাস,দোকানপাট যথেচ্ছভাবে ভাঙচুরের সাথে সাথে আক্রান্ত হন সাংবাদিকরা। আক্রান্ত হয় প্রেস ক্লাব ও কাবাডি অ্যাসোসিয়েশনের তাঁবু।

শুরুতে পুলিশ সশস্ত্র যুবদের ঠেকাতে লাঠি ও কাঁদানে গ্যাস ব্যাবহার করলেও থামানো যায়নি তাদের। ১০০জন পুলিশ কর্মী ও ১০ জন দমকল কর্মীর আহত হয়-সেদিনের তান্ডবে।

পরিকল্পনার ফাঁদে ফেলে পুলিসকে বাধ্য করা হয় গুলি চালাতে। যে Tradition আজও চলছে।

 

১৯৯৩-এর ২১শে জুলাই ঘটনার পর তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্টমন্ত্রী এস বি চ্যবন মহাহকরণে এসে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করে জানতে চেয়েছিলেন,"কেন এমন হলো? কেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত হবেনা?" জ্যোতি বসু জবাব দিয়ে ছিলেন,"দিল্লীতে কেউ যদি আপনার অফিস দখল করতে যায়,হিংসার পথ নেয়,তাহলে আপনি কি করবেন?" তারপর মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে কোথাও কোনো কথা বলেছিলেন বলে জানা যায়নি।  

২৩শে জুলাই-এর ঘটনার পর আনন্দবাজার পত্রিকাও লিখতে বাধ্য হয়-

'ক্ষমতা দখলে সন্ত্রাসের বাঁকা পথ নিচ্ছেন মমতা'    

অবশ্য এই বাঁকা পথে মহাকরণ দখল নেওয়ার সূচনা হয়, ১৯৯৩-এর ৭-ই জানুয়ারি। সেদিনও এ রাজ্যের মানুষ দেখেছিলেন এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর প্রহসন। কিছু বশংবদ সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারকে সাথে নিয়ে তিনি মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনে ঘন্টাখানেক তান্ডব চালিয়ে ছিলেন।

যতই হাস্যকর বা অবিশ্বাস্য হোক না কেন, ক্ষমতান্ধ নেত্রী পরিকল্পিত প্রহসনের অজুহাত আগেই তৈরী করে রাখেন। যেমন, এই প্রহসনের অজুহাত হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলেন, প্রায় চার মাস আগে ঘটে যাওয়া নদীয়ার এক ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষিতা দীপালী বসাক ও তার মা কল্যাণী বসাককে সঙ্গে নিয়ে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মহাকরণের সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়েন তার মন্ত্রীপদকে ব্যবহার করে। শুধু মন্ত্রী নন তার পেটোয়া সাংবাদিকরাও সেদিন আইনভঙ্গ করেন ১৪৪ধারা ভঙ্গ করে। কোন রাজ্যের সচিবালয়ে বা দিল্লীর সংরক্ষিত এলাকায় যে কোনো সংখ্যায় যে কোনো সময়ে অবাধে প্রবেশাধিকার সাংবাদিকদের নেই।

সে যাইহোক, কথা বলার জন্য পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচী না থাকা সত্বেও নেত্রী ধর্ণা শুরু করলেন মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনে। পুলিশ ও প্রশাসনের হাজার অনুরোধ উপরোধ বারবার উপেক্ষিত হলো অন্ধকার জগতের যাবতীয় ভাষার ব্যবহারে। উন্মত্ত নেত্রীর হাতে লাঞ্ছিত ও প্রহৃত ৬জন পুলিশ কর্মী বাধ্য হ'ন হেয়ার স্ট্রীট থানায় জেনারেল ডায়েরী করতে এবং এস আই করুণা চক্রবর্তী,  নিয়তি দাস, পারুল চৌধুরী ও পার্বতী পালকে ওই রাতেই মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য।

 তাকে লালবাজারে নিয়ে যাবার সময় এবং তার লালবাজারে থাকাকালীন সময়ের মধ্যে তার অনুগামীরা ৭৬টি সরকারী এবং ৭৪টি বেসরকারী বাসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। অন্যান্য যানবাহনের সংখ্যা যে কত তা আজও অজানা।

 

১৯৯৩-৯ই জানুয়ারী।  সিদো কানহু ডহরের এক সভায় মমতাপন্থী সৌগত রায় যখন বলেন, "এ রাজ্যে আইন আছে, কিন্তু কেউ মানবেন না, আইন ভাঙ্গুন। পারেন তো পুলিশের টুপী খুলে নিন'। তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এরা কি চায়? বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয় যখন একই মঞ্চে মদন মিত্র ঘোষণা করেন, "সোমবার থেকে কংগ্রেসী মহিলারা যেখানেই আই পি এস অফিসারদের পাবে সেখানেই তাদের বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়ে দেবে।" এই ঘোষণার কিছু পরেই ব্যাঙ্কশাল কোর্টে শুরু হয় কংগ্রেসী হামলা। আগের দু-দিনের ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত ধৃতদের কোর্টে লক আপ ভেঙ্গে বার করে আনতে কোর্ট চত্বরে ব্যাপক বোমাবাজি করা হয়।  মারধর করা হয় নিরীহ টাইপিস্টদের-ভেঙ্গে দেওয়া হয় টাইপ মেশিনগুলো।

অপর দিকে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হামলা শুরু হয় কলকাতা কর্পোরেশনের কর্মীদের উপর।

আজ যারা ভাবছেন, বিকাশ বসু হত্যাকান্ড কংগ্রেস বা তৃণমূলের দলীয় কোন্দলের নমুনা তাহলে একটু পিছিয়ে গিয়ে তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, একটি দেওয়াল লিখনের কথা-

এক সময় হাওড়ার দেওয়াল জুড়ে লেখা হয়েছিল-

'কংগ্রেস(আই)-র মহা গুণ, নেতার হাতে নেতা খুন'

১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসে হাওড়ায় খুন হ'ন প্রদেশ কংগ্রেসের রাজ্যস্তরের নেতা উৎপল ভৌমিক ও আরও এক নেতা দেবু ঘোষ। দু-জনেই ছিলেন সোমেন মিত্র-র অনুগামী। কিছুদিন আগেই প্রদেশ সভাপতি নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জী হেরে যান সোমেন মিত্রের কাছে। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতালোভী নেত্রী ও তার অনুগামীরা ক্ষিপ্ত। তারপরই এই ঘটনা ঘটায় গোষ্ঠী কোন্দলের গন্ধ পেলেন সোমেন মিত্র। সেই মতো তিনি সরাসরি মমতার নামেই অভিযোগ আনেন এবং হাওড়ায় মমতা অনুগামী যুব কংগ্রেস নেতা বিনোদানন্দ ব্যানার্জীসহ ৬জনকে শো-কজ করেন। পরে এক সাংবাদিক বৈঠকে তিনি জানান হত্যাকান্ডে যুক্ত থাকার অপরাধে পুলিশ যে বিনোদানন্দকে গ্রেপ্তার করেছে তা সঠিক সিদ্ধান্ত এবং ঐ একই কারণে তিনিও বিনোদানন্দ ব্যানার্জীকে সাসপেন্ড করেন।  তিনি এখানেই থেমে থাকেননি। কংগ্রেসের তৎকালীন সর্বভারতীয় সভাপতি নরসিমা রাও-এর কাছে অভিযোগ করেন- যুব কংগ্রেসের জন্য এখন প্রদেশ কংগ্রেস দলের নেতাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। কাগজে এ খবর ফলাও করে বেরোনোর পর নেত্রী এতো বেশী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ছিলেন যে, রাজ্যপালের মৃত্যুর জন্য তার সভা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিলেও পরে অনুষ্ঠিত তার সেই সভায় খুন হয়ে যাওয়া দুই নেতার জন্য এক মিনিট নীরবতাও পালন করা হয়নি। 

খুনের পর মমতা হাওড়ায় যাওয়ার সাহস না দেখালেও খুনের অভিযোগে ধৃতদের পক্ষে ওকালতি করে ছিলেন এবং আইনজীবী দাঁড় করিয়ে ছিলেন।

১৯৯৪-২২শে ফেব্রুয়ারি। মমতা মানেই তান্ডব। মমতা মানেই বিশৃঙখলা। তার প্রমাণ আবার পাওয়া গেল বারাসাত কাছারী ময়দানে। এক দিকে  সভায় নেত্রীর উত্তেজক বক্তৃতা। অন্য দিকে কিছু নেতা থানায় হাজির ডেপুটেশনের নামে।  নেত্বৃতের দাবী এক্ষুনি সভার মঞ্চে উঠে পুলিসকে বলতে হবে ১লক্ষ লোককে গ্রেফতার করে ছেড়ে দেওয়া হলো।  পুলিশের পক্ষে কোনো দলীয় সভামঞ্চে উঠে এমন কথা বলা সম্ভব নয় বলেই পুলিশ প্রথমে অস্বীকার করে। তাছাড়া যেখানে সভা হচ্ছে সেখানে কোনমতেই ৩০হাজারের বেশী লোকের সমাবেশ সম্ভব নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা? পুলিশের অসহযোগিতার অজুহাতে লেলিয়ে দেওয়া হলো ভৈরব বাহিনীকে। যুবনেতা গোবিন্দ ব্যানার্জীর নেত্বৃতে বেপরোয়া আক্রমণ নেমে এলো পুলিশের উপর। তান্ডবের শিকার হলেন বহু পুলিশ কর্মী। পরিস্থিতি বিচার করে পুলিশ বলতে রাজি হয়, মাঠের সব লোককে গ্রেপ্তার করে ছেড়ে দেওয়া হলো। কিন্তু না। নেত্রী রাজি নয়। তার সংখ্যা চাই। পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ। গন্ডগোল তখন ছড়িয়ে পড়েছে বাস স্ট্যান্ড, স্টেশন, জেলা পরিষদের অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও বিপরীতে বারাসাত হাসপাতালসহ বহু জায়গায়। আবার বাধ্য করা হলো পুলিশকে গুলি চালাতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারা গেল গোবিন্দ ব্যানার্জী। তান্ডবের শিকার হলেন যেসব পুলিশ কর্মী তাদের মধ্যে একজনকে এক মাস নার্সিং হোমে থাকতে হলো-আর একজনের মৃত্যু হলো।

১৯৯৫-সালে মমতাময়ী অগ্নিকন্যা মমতার মানব দরদী বহর সারা বছর ধরে সেভাবে না দেখা গেলেও তা তেড়েফুঁড়ে বেরলো ৬ই নভেম্বর থেকে। নতুন শীতের আমেজ গায়ে মাখতে দীর্ঘ ২০দিন তিনি ধর্না চালান। কারণ-এ রাজ্যে লক-আপে মৃত্যুর ঘটনা। ধর্নার সাথে সাথে চলছে সি বি আই-এর নাম জপা। বার বার কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করা সত্ত্বও সেখান থেকেও কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। এদিকে রাজ্য সরকারও অনড়। অপরাধ জগতের মানুষদের প্রতি কোনো দয়া দেখাতে তারা রাজি নন। ওদিকে দীর্ঘ দিন ধরে ধর্নায় বসে কোন লাভ নেই বুঝে নেত্রী পালানোর পথ খুঁজছেন। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের লেটারহেডে পাঠানো ভুবনেশ্বর চর্তুবেদীর চিঠিতে মান বাঁচল এবং তিনি চিঠি আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে ধর্না তোলেন।

১৯৯৬-আলিপুর-এর এক মিছিল শেষের ভাঙ্গা জনসভায় অধীর চৌধুরী, সুলতান আহমেদ-সহ কংগ্রেসের পাঁচ দুষ্কৃতি কে নির্বাচনে প্রার্থী করার প্রতিবাদে তিনি নিজের কালো শাল গলায় জড়িয়ে আত্মহত্যা-র অভিনয় করেন। সেই ঘটনা প্রসঙ্গে সোমেন মিত্র কটুক্তি করে বলেন-"রাস্তার মোড়ে বিনে পয়সায় এরচেয়ে ভালো অভিনয় হয়না"

ঘটনাবহুল কর্মময় জীবন যার তিনি এটুকুতেই আটকে থাকবেন তা হয় নাকি?

১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে পেট্রোলিয়ামের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে লোকসভার ওয়েলে বসে পড়েন তিনি। এই সময়ই সমাজবাদী পার্টি সাংসদ অমর সিংহের জামার কলার ধরে তাঁর সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন মমতা। সারা ভারত দেখল 'পরিচ্ছন্ন কংগ্রেস' গড়তে চাওয়া নেত্রীর আসল রূপ। 

শালের শক্তি যে ১৯৯৬-তেই থেমে থাকেনি তা বোঝা গেল ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে

লোকসভায় রেল বাজেট পেশের দিন পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বঞ্চনার প্রতিবাদে রেল বাজেট পেশ চলাকালীনই তদনীন্তন রেলমন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের দিকে নিজের শাল ছুঁড়লেন তিনি। পরে তিনি সাংসদ পদ থেকে ইস্তফাও দেন। কিন্তু লোকসভার তদনীন্তন অধ্যক্ষ পি. এ. সাংমা তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাখ্যান করে তাঁকে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ দেন। পরে সন্তোষমোহন দেবের মধ্যস্থতায় তিনি মাথা নীচু করে আবার ফিরে আসেন।

বিভিন্ন কারণে সে সময় কংগ্রেসের টালমাটাল অবস্থা। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে অনেকেই তখন নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। একক ক্ষমতালোভী মমতাও সেই পথের পথিক। যখনই বিপদের আঁচ পান তখনই তিনি সবার আগে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নেন। যেমন করেছিলেন, ১৯৯৮৯-এ নির্বাচনে পরাজয়ের পর তার নির্বাচনী কেন্দ্র বদল করে। তবে এবার তিনি সময় নিলেন 'ঘর ভেঙ্গে ঘর তৈরী' করতে। অজিত পাঁজার উক্তি অনুযায়ী, 'অস্থির মস্তিক'-মমতা কংগ্রেস ভাঙ্গা শুরু করলেন ১৯৯৭ সালের আগষ্ট মাস থেকে। অজুহাত ছিল পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস কার্যত প্রধান শাসকদল সিপিএম-এর তাবেদারি করছে

শুধু তাই নয়। "নির্বাচন কমিশনের স্বীকৃতি আছে যখন, তখন বি.জে.পি অচ্ছুৎ নয়"-এমন কথাও বলা শুরু করলেন। অর্থাৎ পববর্তী আকর্ষণ কি আগেই আঁচ পেল কংগ্রেস নেতৃত্ব। একথার পর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র বলেছিলেন-"বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে যারা বলে, বি জে,পি অচ্ছুৎ নয়, তাদের আর যাই হোক কংগ্রেসে থাকা চলে না।" অবশেষে দলবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ১৯৭৭-এর ২২শে ডিসেম্বর মমতা ব্যানার্জীকে দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলে সেই বছরেই কংগ্রেস ছেড়ে আসা আরও কিছু নেতা-কর্মীকে নিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে মমতা প্রতিষ্ঠিত করলেন পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল কংগ্রেস নির্বাচন কমিশনের কাছে দলের নাম নথিভুক্ত হয়ে গিয়েছিল আগেই৷ মমতা নিজেই নাকি দলের প্রতীক এঁকেছিলেন৷ যদিও পরে অজিত পাঁজা জানিয়ে ছিলেন ঐ প্রতীক চিহ্ন তৈরী করেন তিনি।

১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারি -তৃণমূল কংগ্রেস, দল হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে।  

মমতা ব্যানার্জী মানেই ক্ষমতালিপ্সু মানুষের শেষ কথা- তার প্রমাণ মেলে অচিরেই।

১৯৯৮-হ'ল অন্তর্বর্তী লোকসভা নির্বাচন। নির্বাচনে ভরাডুবি হোলো কংগ্রেসের। ফলাফলে কুমারী ব্যানার্জীর লাভ কত হলো পরবর্তীকালে তা বোঝা গেল। ভোটের আগেই বি.জে.পি-র তপন সিকদার বলে ছিলেন "মমতা ব্যানার্জীর উচিৎ কংগ্রেস ছেড়ে বি.জে.পি-র সাথে ফোরাম তৈরি করা।"কুমারী ব্যানার্জী যে,'যখন যেমন তখন তেমন'-তা বোঝাতে বেশী দেরী করলেন না। শুরু হ'ল আসন সমঝোতা করে-এক মঞ্চ থেকে যৌথ কর্মকান্ড। এক দিক থেকে বি.জে.পি-র সাম্প্রদায়িকতা এবং অপর দিকে দোসর তৃণমূল-এর হিংসাত্মক অরাজকতা।

নির্বাচনে ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে সি পি আই এম-এর কাউন্টিং এজেন্টরা লাখখানেক ব্যালট পেপার টেবিল থেকে সরিয়ে এনে বাইরে ফেলে দিয়েছে বলে বছর শুরু করল তৃণমূল কংগ্রেস। এই অভিযোগ যখন ধোপে টিকলো না তখন বলা হলো গণনায় কারচুপি হয়েছে। পরাজয়ের কারণ হিসেবে সহজ সরল সমাধান।

 '৯৮-এর নির্বাচনের পরেই-ফেব্রুয়ারি মাসে চিত্রাভিনেত্রী সন্ধ্যা রায় বাঁকুড়ার বৈতল থেকে যাত্রানুষ্ঠান সেরে দল নিয়ে ফেরার পথে গড়বেতার কাছে বাঁকুড়ার জয়পুর থানা এলাকায় ডাকাতদলের হাতে আক্রান্ত ও  সর্বস্বান্ত হন। ঘবরের কাগজে এটাই ছিল মূল খবর। পরবর্তীকালে জানা যায় ডাকাতি যারা করেছিল তারা গড়বেতারই বাসিন্দা। সেই ডাকাত দলের পরিবার প্রথমে সি পি আই এম নেতৃত্বের কাছে যান জামিনের ব্যাবস্থা করতে-বিফল হয়ে শরণ নেন নেত্রীর।  'লাল দূর্গে' আঘাত হানতে কেউ তার কাছে অচ্ছুৎ নয়। বিনিময়মূল্য হিসেবে সদ্য জোট বাহিনী আসরে নেমে পরে এবং ডাকাতদলের জামিনের ব্যাবস্থা করে। খুব স্বাভাবিকভাবেই জামিন প্রাপ্ত ডাকাতরাই পরে এক একটি দলীয় কমিটির প্রধান হয়ে যায়। ছিল ডাকাত, হ'ল নেতা।

১৯৯৮-৭-ই মার্চ । শাসনে তৃণমূল, বি.জে.পি-র যৌথ বাহিনী সি পি আই এম কর্মী বরহানকে খুন করতে উদ্যত হলে গ্রামের মহিলারা বাধায় সে যাত্রায় বরহান প্রাণে বেঁচে যান।

২০শে মে ১৯৯৮ বহিরাগত দাগী আসামীদের সাহায্যে শাসনের কৃষক সভার নেতা মুজিদ আলিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে হত্যার চেষ্টাও ব্যর্থ হয় স্থানীয় গ্রামবাসীদের প্রতিরোধে। 

বারবার ব্যর্থ হয়ে শেষে কিছু সংবাদপত্রের সহযোগিতায় সুচতুরভাবে লাগাতার নানা মিথ্যে গুজব ছড়িয়ে প্রশাসনকে ব্যস্ত রেখে ২নং ব্লকের ৭টির মধ্যে ৬টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করে নেয় তৃণ-বি জে-পি জোট।

২৯শে মে জোটের দুষ্কৃতিরা বাঁদাসানবেড়িয়া গ্রামে বেপরোয়াভাবে গুলি চালায়।

৩১শে মার্চ এই বাহিনী সান্তালিয়া গ্রাম আক্রমণ করলে যুবকর্মী রফিকুল ও রসিদ গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।

সি পি আই এম পার্টির সদস্য জাহাঙ্গীরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

পারঘড়িবাড়ির প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক রোস্তম আলিকে মেরে মৃত মনে করে উলঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রেখে যায়।

শুধু অত্যাচারই নয় গ্রামবাসীদের উপর জরিমানা ধার্য ও ১০ থেকে ২০ কোটি টাকার মাছ ভেড়ি থেকে লুঠ হয় তৃণমূল জেলা পরিষদ সদস্য আব্দুর রউফের নেতৃত্বে।

১৯৯৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে নেত্রী শ্লোগান তুললেন-"কেশপুর হবে শেষপুর"। শুরু হলো হিংসাশ্রয়ী অভিযান। নেতৃত্বে মহম্মদ রফিক। সাথে রইল কেশপুরেরই বারোমাস্যা গ্রামের কুখ্যাত ববি নায়েক ও বুদ্ধ মাহাতো। একই সাথে চলল 'পাশকুঁড়া লাইন'-এর কাজ। নির্বাচন যত এগিয়ে আসতে লাগলো-ততই বাড়তে লাগলো হিংসার আগুন।

৯৯৮-৯-ই এপ্রিল । খানাকুলের কেওটপারায় সি পি আই এম-এর অফিস গুঁড়িয়ে দেওয়ার সাথে সাথে বাজারের ২০টি দোকান লুঠ করা হ'ল। 

১৯৯৮-১০-ই এপ্রিল। রফিকের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র মিছিল লাঙলডিহি গ্রামে ঢুকে ব্যাপক বোমাবাজি শুরু করে সকাল থেকেই। পাঁচটি বাড়ি লুঠ করা হয়। সময় কম কাজ অনেক-এই মানসিকতায় ঐ দিনই রামেশ্বরচকে একই কায়দায় আঘাত হানা হল। বোমার আঘাতে আহত হলেন ১০জন নিরীহ গ্রামবাসী। খুন হলেন ঈশাণ বসাক।

এর কয়েক দিনের মধ্যেই সি পি আই এমের ৯টি পার্টি অফিস ধূলিস্মাৎ। আক্রান্ত পার্টিকর্মীরা। জগন্নাথপুরে খুন হলেন আব্দুল কাদের।

ক্যালেন্ডারের দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে তান্ডবলীলা। একটা করে দিন যাচ্ছে আর এক এক করে দখল হচ্ছে গ্রামগুলো।

১২ই মে-গোলাড়।

১৫ই মে-বুড়াপাট।

১৯শে মে-সাতশোল।

২১শে মে-কেওনসা।

২৫শে মে-কোনান।

২৬শে মে-খাগড়াগেড়িয়ায় আক্রান্ত হলেন বিধায়ক নন্দরানী ডল।

ঐদিনেই বাঁকুড়ার জয়পুর থানার অধীন আঙ্গারিয়া ও শালতোড়ায় তৃণমূল বীভৎস তান্ডব চালায়। খালের ওপারে গড়বেতার হেমনগর থেকে নিয়ে আসা ডাকাতদলকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ করে আঙ্গারিয়া গ্রাম। সারাদিনের তান্ডব শুরুর আগে খালের ওপার থেকে আসা ডাকাতদল মহানন্দে নদীর পাড়ে পিকনিকও করে।

দিনের সাথে সাথে একে একে খুন হতে থাকেন-সামাই হাঁসদা, নন্দ সামন্ত, বিমল আড়ি, সৈকত লোহার,ওসমান আলি, সহ বহু মানুষ। যাদের অপরাধ হয় তারা সি পি আই এম কর্মী বা সমর্থক। 

সেসব দিনের অত্যাচার প্রসঙ্গে কট্টর তৃণমূল সমর্থক ৫৬ বছরের হারোজ আলি ও একদা কেশপুরের মুক্তিযুদ্ধ'-এর উজ্জ্বল নক্ষত্র চিত্ত গড়াই কি বলেছেন সেকথা আজ আর গোপন নেই। গোপন নেই রফিকের অবস্থানও।  

১৯৯৮-২১শে মে রাজ্যের পঞ্চায়েত ঠিক ছয় দিন আগে-ভাঙ্গড়ের অশ্বত্থবেড়িয়া গ্রামে বাড়ির কাছে পুকুরপাড়ে অচৈতন্য ও বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া যায় চম্পলা সর্দার নামে এক গৃহবধুকে। গ্রামবাসীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথেই চম্পলা জনিয়ে দেন তিনি ধর্ষিতা হয়েছেন পাঁচজন সি পি আই এম কর্মী দ্বারা। পঞ্চায়েত প্রার্থীর সম্ভ্রমহানির ঘটনা সারা ভারতের কাছে জানাতে মিডিয়া সময় নেয় কয়েক ঘন্টা।

২২শে মে গ্রেফতার হ'ল অভিযুক্ত দুই সি পি আই এম কর্মী।

তদন্তে নেমে তদন্তকারী অফিসাররা পড়লেন ফাঁপড়ে। অভিযোগ অনুযায়ী ২০শে মে রাতে তিনজন চম্পলার বেড়ার দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে মেঝেতে শুয়ে থাকা তার স্বামী পালান সর্দার ও তক্তপোষের উপর শোয়া তিন সন্তান এর মধ্যে থেকে তাকে তুলে নিয়ে গেল অথচ ঘরের কেউ টের পেল না!!  এখানেই শেষ নয়। ধর্ষণের ঘটনার পর চম্পলার স্বামী পালান সর্দার কেন পালিয়ে গেলেন সেটাও ছিল রহস্য। পালিয়ে  কোথায় ছিলেন আপনি পালান সর্দার? আপনার মতো জনপ্রিয় মানুষকে সোনারপুর, বারুইপুর অঞ্চলের তৃণমূলের অনেক নেতার বাড়িতেই তো তখন দেখা গিয়ে ছিল! তবুও পালিয়েই ছিলেন!!

তখন বানিজ্যিক মিডিয়াগুলো ছিঁড়ে খাচ্ছে সি পি আই এম ও সরকারকে, অতএব কিছু তো করতেই হবে! যাইহোক, অভিযোগ ছিল পাঁচজন চম্পলাকে ধর্ষণ করেছে। কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় শরীরের কোথাও তার বিন্দুমাত্র আঘাত খুঁজে পাওয়া গেলনা। তাতে কি আসে যায়? ভগবানের নাম নিয়ে আনন্দ সহকারে প্রতিদিন চলছে মিডিয়া সন্ত্রাস।

সেই করা হ'২৩শে মে। পেট ও মাথার যন্ত্রণায় কাতর পঞ্চায়েত প্রার্থীকে নেত্রীর পাঠানো গাড়ি করে নিয়ে এসে ভর্তি করা হলো গড়িয়াহাটের কাছে এক 'বিশেষ' নার্সিং হোমে। যেখানে রুগীর সাথে দেখা সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ। দেখা করতে পারলেন যারা তাদের মধ্যে বিশেষজন হলেন 'জর্জ ফার্নান্ডেজ'। বহিন-এর অনুরোধে সি পি এম-এর নৃসংশতা স্বচক্ষে দেখতে ছুটে এলেন।

 যতভাবে সম্ভব সব দিক থেকে চেষ্টা চরিত্র করেও লাভ কিছু হলনা। যাকে শিখন্ডি করে ভোট বৈতরণী পার হতে চাওয়া সে নিজেই পরাজিত হ'ল। ফল ঘোষণার কয়েক দিন পর চম্পলা সর্দার যখন ছেলের হাত ধরে নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে-সেদিন টি এম সি-র সামান্য একটা সমর্থকও ছিলনা তার পাশে। লজ্জিতা চম্পলার ইন্টারভিউ নেবার জন্য ছিলনা কোনো সাংবাদিক। খেজুরি-র সুজাতা দাস মারা না গেলে আমরা বোধহয় আরও একটা চম্পলাকে পেতাম। চম্পলা আজও বেঁচে আছেন। আছেন অশ্বত্থবেড়িয়ার সেই বাড়িতেই। কেমন আছেন চম্পলা আপনি? আপনি ভালো থাকুন চম্পলা-জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মমতার নোংরা রাজনীতির স্বীকার হওয়ার লজ্জা নিয়েই বেঁচে থাকুন।

১৯৯৮-৩০শে মে

পঞ্চায়েত নির্বাচন-এর দু-দিন পরেই ঘটলো এক লজ্জাজনক ঘটনা। 

পঞ্চায়েত নির্বাচননে পঞ্চায়েত প্রার্থী সালাম খাঁ ও তার দলবল বাঁকুড়ার বিক্রমপুরের বাসিন্দা সি.পি.আই.এম কর্মী আব্দুল গণি খাঁ-র বাড়ি আক্রমণ করল। আব্দুল খাঁ কে না পেয়ে তার স্ত্রীকে বিবিস্ত্র করে তার ক্লাস নাইনে পড়া ছেলের সামনে এবং ছেলেকে শূন্যে তুলে তিন তিন বার মাটিতে আছাড় মারে। আসে পাসের মানুষ প্রতিবাদে এগিয়ে এলে তাদের বেপোরোয়া গুলি ও বোমা চালানো হয়। গুলিতে প্রাণ হারান সি.পি.আই.এম কর্মী ওসমান আলি।

এর মাঝে বহু ঘটনাই ঘটেছে-তবে সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা ঘটলো ১৯৯৮-এর ৩১শে অক্টোবর। বাংলার ইতিহাসে কলঙ্কময় দিন। খানাকুলের 'বলপাই' গ্রামে দৌলতচক গ্রামীণ পাঠাগার-কে শুধু বোমা মেরে ভস্মীভূত করে দিল তৃণমূল দুষ্কৃতীরা। ৩০ বছর আগে জমিদার-জোতদারদের হাত থেকে ভুখা মানুষের দল খাস জমি দখল করার আন্দোলনের সাথে সাথে মাত্র একজন স্নাতক নিয়ে নিজেদের উদ্যোগে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিল এই পাঠাগারটি। ১৯৭৭ সালের পর সরকারী স্বীকৃতি পাওয়ায় তা আরও বড় হয়। পাঠাগারকে কেন্দ্র করে তৈরী হয় খেলার মাঠ, নাট্যমঞ্চ ও নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযান।

"সি.পি.এম. বানানোর কারখানা"-এই অপবাদে যখন পাঠাগারটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো তখন তফসিলী জাতি অধ্যুষিত ওই পাঠাগারের পাঠকের সংখ্যা ছিল ১১০০।

আজ দৌলতচক গ্রামীণ পাঠাগার মাথা তুলে আবার বলছে "বই পোড়াতে হয় না, পড়তে হয়"

 

"দিদি আপনি আমাদের বুলেট দিন। আমরা আপনাদের হাতে মেদিনীপুর তুলে দেব"-বিনিময়মুল্যের একথা তো তৎকালীন তৃণমূল নেতা মহম্মদ রফিকের। সোজাসাপটা একথা আজ আর চাপা নেই। আনন্দবাজারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই রফিক-ই তো বলে ছিল-"পৃথিবীর ইতিহাসে আছে, ভদ্রভাবে কমিউনিস্টদের কোনও জায়গা থেকে সরানো যায়নি।ওদের মেরে তাড়াতে হবে।এখান থেকেও তাড়াতে হবে।" সুতরাং বুলেট তো চাই-ই।

ধন্যবাদ রফিক, ভীষণ সত্য কে উপলব্ধি করার জন্য। পারেননি আপনিও-পারবেন না আপনারাও। 

 

রফিক পারুক, না পারুক, নেত্রী ইতিমধ্যে এক অসাধারণ কার্য-সাধন করেছেন। সাত-দিনের জন্য বি.জে.পি.সরকারকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ রেখেছেন! এই প্রথম বোধহয় মিডিয়াও ভাষা হারিয়ে ফেলল-তার নতুন নাটকে! 'সমর্থন স্থগিত'-মানে কি? অবশ্য সেই নাটকের যবনিকা পতন হোল প্রধানমন্ত্রীর ও জর্জ ভাইয়া-র দৌত্য ভূমিকায়।  

সময়ের গড়িয়ে চলার সাথে সাথে, জন্মের প্রথম বছরেই বাংলা তথা ভারত চিনল-কুমারী মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে থাকা তৃণমূলকে। বাংলা জানলে আজ হয়ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিভৃতে বলতেন,"তুমি যা জিনিষ গুরু, আমি জানি-আর কেঊ জানেনা...।"

 

১৯৯৯-এ আবার নির্বাচন। অনেক মিথ্যের মধ্যে ঐ বছরের শ্রেষ্ঠ মিথ্যা বললেন-দূর্গাপুরের এক নির্বাচনী জনসভায়। বলা যায়, মিথ্যাচারিতা ও ভন্ডামির মুকুটে একটি মূল্যবান পালক যোগ করলেন এই বলে, "ফ্যাক্স এসে গেছে, এম.এম.সি বন্ধ করা হবে না"। কতটা নির্লজ্জ হলে এমন মিথ্যা বলা যায় তা এম.এম.সি-তে কর্মরত মানুষেরা অল্প দিনেই বুঝলেন।

 

১৯৯৯-২রা জুন-

একটি চিঠি পাওয়া গেল। তাতে লেখা ছিল,"...আগামীকাল আমরা সমস্ত জায়গা ঘেরাও করিব। সেই মোতাবেক সমস্ত নেতা মিলে কাজ করিবেন। কালকেই শেষ লড়াই করিব। রফিক বলে পাঠিয়েছে। সেই হিসেবে ছক করিবেন।..ইতি নুরুলদা"এই নুরুলদা হলেন নুরুল হক। কেশপুরে তৃণমূলের ডাকসাইটে  নেতা। আর রফিক হলেন-স্বয়ং মহম্মদ রফিক। মেদিনীপুরের স্থানীয় ভাষায় লেখা এই চিঠি সেই দিনই বিলি করা হয়। এই চিঠি লেখা হয়েছিল-কেশপুরের 'নৈশ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কাস্‌'-নামে একটি লেদ কারখানার প্যাডে। যার মালিক মীর নুরুল হক। পুলিশ ওই কারখানা তল্লাসী চালিয়ে প্রচুর বন্দুক,পাইপগান ও কামান উদ্ধার করে। এছাড়াও কেশপুরেরে খেজুরবনী গ্রামে প্রচুর অস্ত্র, বিস্ফোরক পদার্থসহ ১০জন তৃণমূলী সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়।

তবুও আটকানো যায়নি ৩রা জুনের আক্রমনের ছক। সেদিন দুপুরেই কেশপুরে পারুলিয়া গ্রামের পারাৎ নদীর কাছে নৃশংসভাবে খুন করা হয় সি.পি.আই.এম-এর এক নেতা সহ চারজন পার্টি কর্মিকে। প্রাণ বাঁচাতে এক পার্টি কর্মী পাশের আদিবাসী অধ্যুষিত রায়পুকুরিয়া গ্রামের এক বাড়িতে ঢুকলে সেই বাড়ি ঘিরে ফেলে লুঠতরাজ করা হয়। এছাড়াও ওই দিন গুলি করে খুন করা হয় জিতেন মন্ডল ও গয়া জানা নামে বিশ্বনাথপুর লোকাল কমিটির দুই সদস্যকে। খুন হন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক পঙ্কজ ভৌমিক। তিনি ছিলেন কইজুড়িয়া শাখার সম্পাদক।

পরে মেদিনীপুর, পিংলা ও কেশপুরের মাটি খুঁড়ে মিলেছে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বহু পার্টি কর্মীর মৃতদেহ।

 

২৩শে সেপ্টেম্বর-১৯৯৯-

সকাল দশটা নাগাদ সি.পি.আই(এম)-এর সর্বভারতীয় সাধারন সম্পাদক, হরকিষেণ সিং সুরজিৎকে বিরাটি রেলগেট অবরোধ করে তাঁর গাড়ির ওপর ক্রমাগত আঘাত করা হয়। ভেঙ্গে দেওয়া হয়, গণশক্তি'-র গাড়িটি।

ঐ দিনই একইভাবে টিটাগড় থেকে বরানগর যাবার পথে আবার ওই একইভাবে পানিহাটিতে তাঁর গাড়ি আক্রমণ করা হয়। আহত হ'ন পার্টি কর্মী রাণা কুন্ডু ও খড়দহ থানার ও.সি অজিত আনন্দ ভট্টাচার্য।

এই নিন্দনীয় ঘটনার মোড় ঘোরাতে 'তপন শিকদার' আক্রান্ত'-মিথ্যে গুজব ছড়িয়ে দমদম লোকসভা কেন্দ্রর নানা জায়গায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও হাঙ্গামা করে তৃণমূল-বি.জি.পি. জোট সঙ্গীরা।

 

এই জোটের আরও কিছু কর্মকান্ড জানা যায়, যদি আর কয়েক মাস পিছিয়ে যাই-

দিনটা ছিল ১৯৯৯এর ৯-ই সেপ্টেম্বর।

গড়বেতায় স্বরূপ সরকার নামে এক আর এস এস কর্মী আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ওই খুনের পর তৃণ-ভাজপা যৌথ বাহিনী এই কান্ডের মূল হোতা সাব্যস্ত করে স্থানীয় জনযুদ্ধ সংগঠনের নেতা অসিত সরকারকে খুঁজতে থাকে। তাকে না পেয়ে সঙ্গীপুর হাই স্কুলের শিক্ষাকর্মী অনাথ সরকারকে স্কুলের ভিতর থেকে পিছমোড়া করে বেঁধে  তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বোষ্টম মোড় এলাকায়। অনাথের অপরাধ তিনি সম্পর্কে অসিত সরকারের ভাই। প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, প্রথমে তার চোখ দুটি খুবলে নেওয়া হয়। তারপর মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় লোহার রড এবং শেষে খড়্গ দিয়ে শরীরটাকে চার টুকরো করা হয়।

আজ তৃণমূল কংগ্রেসের লোকদের যদি একমাত্র জীবিত সাক্ষী অনাথ সরকারের ছোট ভগ্নীপতি অশোক ঘোষ জিজ্ঞাসা করেন- কেন মৃত ভাইকে দেখতে এসে তার স্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ হতে হ'ল? কেনইবা অনাথ সরকারের মাকে মেরে কোমর ভেঙ্গে দিয়ে অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হ'ল? কেন অনাথ সরকারের বড় বোন ঝরনার ছেলে শ্রীমন্তকে অপহরণের পর আজও সে নিখোঁজ? কি জবাব দেবেন?

কুমারী ব্যানার্জী আপনি আজও বলে চলেছেন বারাসাত ২নং ব্লকে বিশষতঃ শাসনে আপনার কর্মীরা ভীষন ভাল। হ্যাঁ, আপনার কাছে যারা ভালো-তারা কেন ভালো তা বোঝা গেছিল সেই ১৯৯৯ সালেও। ওই বছর ২৫শে আগষ্ট  আপনার দলের জেলা পরিষদের নির্বাচিত সদস্য আব্দুর রফিকের বাড়ি থেকে যখন বহু খুনের আসামী শহীদ বিশ্বাসকে পাওয়া যায়। সাথে উদ্ধার হয়- ৩টে মাস্কেট, ৩টে পাইপগান, ১৫টি তাজা বোমা ও দেড় কিলো বোমার মশলা। এ খবর সেদিন কোনো সংবাদপত্র চেপে রাখতে পারেনি। শুধু আপনি বলেছিলেন, "সি পি এম-এর চক্রান্ত"। শুধু প্রশ্ন-কোনটা চক্রান্ত? আব্দুর রফিকের বাড়ি থেকে যখন বহু খুনের আসামী শহীদ বিশ্বাসকে পাওয়া? নাকি ঐ অস্ত্র উদ্ধার?

সবই যদি "সি পি এম-এর চক্রান্ত"-হয় তাহলে ১৯৯৯-এর ১০ই ফেব্রুয়ারি যে প্রহসন করেছিলেন তার উত্তর কি দেবেন? ব্রিগেডে আপনার দলের সমাবেশে,'প্রধানমন্ত্রীর দূত'-প্রমোদ মহাজন ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ভি রামমূর্তি কি বলে ছিলেন মনে আছে?

প্রমোদ মহাজন বলেন-"পশ্চিমবঙ্গ থেকে কোন সরকারী অফিস সরানো হবে না"। আর ভি রামমূর্তি বললেন, "পশ্চিমবঙ্গে তেল অনুসন্ধান কাজ বন্ধ হবে না, আরও তিনটি অঞ্চলে নতুন করে কাজ শুরু হবে"

তারপর আপনাকে না জানিয়েই কি স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া-র বৈদেশিক মুদ্রা বিভাগ মুম্বাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়ে ছিল? 

ওই বছরের ৬ই ডিসেম্বর আপনার সহকর্মী রাম নায়েক যখন জানান-পশ্চিমবঙ্গে তেল অনুসন্ধানের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। রেলমন্ত্রী হিসেবে আপনি কতটা আনন্দ পেয়ে ছিলেন যেমন জানিনা তেমন জানা হয়নি আপনি কোন প্রতিবাদ করে ছিলেন কি না! কবেই বা করেন? কেন করেন না মন্ত্রীত্ব চলে যাবার ভয়ে? মন্ত্রীত্বে থেকে কিইবা করেন-জনসভায় মিথ্যে ভাষণ ছাড়া? আসুন- আপনার কাজের দৃষ্টান্ত দেখা যাক-

১৯৯৯- আপনি তখন রেলমন্ত্রী-

কর্মচ্যুত হলেন ২৪ হাজার রেল কর্মচারী।

ব্রেথওয়েট,বার্ণ স্ট্যান্ডার্ডের মতো রাস্ট্রায়ত্ত সংস্থা যারা রেলের ওয়াগন তৈরি করে তাদের বরাত কমিয়ে বেসরকারি সংস্থাকে বরাত ও বরাদ্দ বাড়িয়েছিলেন। ফলে ওই দুই রাস্ট্রায়ত্ত সংস্থার শ্রমিকদের ৫০ শতাংশ উদ্বৃত্ত হয়েছিল। শ্রমিক দরদী আপনি  কি চেয়ে ছিলেন? লোকসানী সংস্থায় পরিণত করে রাস্ট্রায়ত্ত সংস্থা দুটিকে তুলে দিতে?

চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ কারখানাতে ১৫কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০০০ অশ্বশক্তিসম্পন্ন আন্তর্জাতিক মানের উচ্চক্ষমতাবিশিষ্ট রেল ইঞ্জিন নির্মাণের ব্যবস্থা থাকা সত্বেও রেল দপ্তরের মাধ্যমে কানাডা থেকে ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫০০০ অশ্বশক্তিসম্পন্ন রেল ইঞ্জিনের বরাত দিয়েছিলেন। ফলে কম উৎপাদনের অজুহাতে চিত্তরঞ্জনে ৫০০০ শ্রমিককে ছাটাই করা হয়।

আপনি নিজেকে বামপন্থীদের চেয়েও বড় বামপন্থী হিসেবে যখন প্রতিষ্ঠা করতে চান-তখন আপনার এই প্রক্রিয়াই বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় না কি?  

 

 এলো ২০০০ সাল।  পাঁশকুড়া উপ-নির্বাচন। বলা যায়-কুখ্যাত উপনির্বাচন। পাঁশকুড়া লাইন।

"এই ভোট ওয়ান ডে ম্যাচ। ম্যাচের দিন ঠিকঠাক খেলাটাই জরুরী"। ভোটের দু-দিন আগে রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সাংবাদিকদের ঠিক এই কথাটাই বলেছিলেন।

৫-ই জুন ভোটের শেষে বামফ্রন্ট যখন ৩০টি বুথে পুননির্বাচনের দাবি করে, রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, "ইটস্‌ বাই অ্যান্ড লার্জ ও কে"। রফিকের পিঠ চাপড়ে বলা হয়ে ছিল "ওয়েল ডান। বাপের ব্যাটার মত কাজ করেছিস"

এবার দেখা যাক ওই ৩০টি বুথের ভোটের ফলের কিছু নমুনা।

মোট ভোট পড়ে ১৯৭০৮টি। তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ১৮,৭১৯টি। বামফ্রন্ট ৮৪০। বিক্রম সরকারের ৪৮হাজার ভোটে জেতার এটা একটা ছোট্ট নমুনা।

এই ৩০টা বুথ বাদ দিলে বাকি ২৪টা বুথের নমুনা আরও হাস্যকর।

মোট ভোট পড়ে ১৮৯৩২টি। তৃণমূল ১৮১০২টি। বামফ্রণ্ট ১৭৯টি।

একাধিক বুথে ১০০% ভোট যেমন পড়ে তেমন নির্বাচনের আগেই মারা গিয়েছেন এমন ২০জন মৃত ভোটারও ভোট দেন এবং মৃত মানুষেরা যে তৃণমূলকেই ভোট দেন তার প্রমাণ-ঐ ১১০নং বুথে বামফ্রণ্ট-এর প্রাপ্ত ভোট ২। হ্যাঁ ০২টি। মোট ৬১৬টি ভোটের ৬১৪টি ভোট পায় তৃণমূল কংগ্রেস।

পরে সাংবাদিকরা কুমারী ব্যানার্জীকে এমন ভোট-এর রহস্য জিজ্ঞাসা করাতে, তাদের বলা হয়-"আমায় খোঁচাবেন না বলে দিচ্ছি। ফল ভালো হবে না"

ফল খারাপ হলে তা কেমন হতে পারে-তা বোঝা গিয়ে ছিল ১৪-ই মে ২০০০। যেদিন কেশপুরে নির্বাচনী সভায় গিয়ে রেলমন্ত্রী বলে ছিলেন, "সি পি এম কর্মীদের হাত-পা কেটে নিন"

হাত-পা শুধু নয়, নির্বাচনের ১০-দিন আগেই সবং ও পিংলার মধ্যে ১৫ কিলোমিটার রাস্তা কেটে ফেলা হয়ে ছিল যাতে হামলার পর যাতে পুলিশ প্রশাসন দ্রুত পৌঁছতে না পারে। কালো হেলমেট ও কালো পোষাকে রফিক বাহিনী হামলা করলো-বলপাই,বেড়চা,শালিয়াড়া,তিলন্তপাড়ায়। সি পি আই(এম) জেলা সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হেম ভট্টাচার্যের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে বোঝানো হল-প্রয়োজনে তৃণমূল-বাহিনী আরও কত হিংস্র হতে পারে।  এমনকি ঐ ১০দিন বামফ্রন্ট প্রার্থীকেও পিংলায় ঢুকতে দেয়নি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তৃণমূল কংগ্রেস।

'এখানেই শেষ নয়-কোম্পানী আরও দিচ্ছের মত ঘটনা হ''-সবং-এর সি পি আই(এম) প্রধান লক্ষ্মী মান্ডিকে গ্রামছাড়া করা হয়। এমনকি পঞ্চায়েত অফিসে রাখা মিড-ডে মিলের চাল ও লুট করে নেওয়া হয়।

কেশপুরের ডলং গ্রামের গৃহবধু দীপু মজুমদার সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন ওই নির্বাচনে। তাঁর গ্রামের ১০৭১টি ভোট তাঁকে একা দিতে বাধ্য করেছিল রেলমন্ত্রীর 'বাপ কা ব্যাটারা'। ঐ ভোটের সব কটি পায় ঘাসফুল প্রতীক।

সেদিন বাহাত্তরের নির্বাচনকেও হার মানিয়ে ছিল রেলমন্ত্রীর-'পাঁশকুড়া লাইন'

 

২০০০ সালের সেপ্টেম্বর।

সব মিলিয়ে মাত্র সাত দিন রেল ভবনে সময় কাটিয়ে ছিলেন কুমারী রেলমন্ত্রী-বাকি সময়? ছিলেন তিনি ছিলেন। দিন কাটিয়ে ছিলেন মেদিনীপুরের 'শিরোমণি পর্যটক' আবাসে। ভাড়া দৈনিক ২৪-হাজার টাকা। কিন্তু সেই সুখের অসুখ হলো ৬ই সেপ্টেম্বর। কথা ছিল তিনি যাবেন কেশপুরে কেশপুরে গণসংযোগ কর্মসূচিতে। পুলিশকেও তেমনি বলা হয়ে ছিল। কিন্তু পরিবর্তন করতে হলো সে কর্মসূচি। জানা গেল এল আই সি মোড়ে 'ঘরছাড়া' তৃণমূলি'-নামে যাদের এনে রাখা হয়ে ছিল তারা বিদ্রোহ ঘোষনা করেছে। তারা নেত্রীর সমবেদনা নাটকের কুশীলব হতে আর রাজি নন। সারা দিনের প্রচার মাঠে মারা গেল। নেত্রীও রাজি নন এহেন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে। চটলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। চিত্ত গড়াই-এর নেতৃত্বে পর্যটক আবাসের সামনেই শুরু হলো  বিক্ষোভ সভা। কি বলে ছিলেন সেদিন চিত্ত গড়াই?

"নেত্রী বলেছিলেন, কেশপুর পথ দেখাবে। কেশপুর তো পথ দেখালো-এদিকে আমরা তো পথে বসেছি। আমরা কেশপুরে ফিরতে পারছি না-নেত্রী বরং আমাদের হাতে বিষ তুলে দিন।"

কি করে ফিরবেন কেশপুর? ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে গন্ডগোলের জেরে নিজেরাই তো দু-ভাগে বিভক্ত! এক দিকে চিত্ত গড়াই অপর দিকে মহম্মদ রফিক। ঐ সময় যিনি ছিলেন আবাসের ভিতরে নেত্রীর ঘনিষ্টদের মধ্যে একজন হয়ে। কেশপুর জয়ের দু-মাসের মধ্যেই রবিনহুড 'ভূমিপুত্র' সেনাপতি থেকে এক্কেবারে ভিলেন হয়ে অন্দর মহলে দিদির অঞ্চল ছায়ায়...। আর বাইরে নুরুল হক, জব্বর শেখ, অসিত ত্রিপাঠি বিষদ্গার করে চলেছে নেত্রী ও তার 'বাপ কা ব্যাটা'-র সেনাপতির।

সেনাপতি-র কাজের ছোট্ট একটা নমুনা জানা গিয়ে ছিল-আসার মল্লিকের ছেলে সিরাজুল মল্লিকের কাছ থেকে। সি পি এম-এর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধে শহীদ হলেন আসার মল্লিক। তৃণমুলীরা গড়বেতায় আসার মল্লিক-এর পাঁচ ছেলে ও স্ত্রী-র জন্য চাঁদা তোলে। লক্ষাধিক টাকা ও ৬ কুইন্ট্যাল চাল সংগ্রহ হয়। কিন্তু এক দানা চাল বা একটি পয়সাও 'শহীদ'-এর পরিবারের হাতে পৌঁছোয় না। সিরাজুল সেকথা নেত্রীকে জানাতে চাইলে তাকে বলা হয়-'তোরা পাঁচজন জোয়ান ভাই-তোদের ভাতের চিন্তা কিসের? কিছু না পারিস ভিক্ষে করে খা। আর তোর মাকে বল...।"

বক্তা-'বাপ কা ব্যাটা' মহম্মদ রফিক। স্থান- রফিকের তৎকালীন অস্থায়ী ঠিকানা হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীট্‌। 

এরপর শহীদ আসার মল্লিক-এর পরিবারকে উৎখাত করা হয় ভিটে থেকে- 'শহীদ'-এর পরিবার আশ্রয় পায় সি পি আই(এম)-এর ত্রাণ শিবিরে।

প্রায় একই ঘটনা ঘটে ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্য তৃণমূলীদেরও। তারা হলেন কেশপুরের সোরুই গ্রামের আনসার আলি, গড়বেতার উত্তর বিলের মণিরুদ্দিন মল্লিক, আফসার আলি গায়েন। রেহাই পাননি-গড়বেতার বৈষ্ণব মোড়ের তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি মুজিবর রহমান। কেশপুরের ধনডাংরার সবচেয়ে বিত্তশালী তৃণমূল সমর্থক শেখ মহীউদ্দিন। তিন তার ছেলে ও জামাই-এর প্রাণ ভিক্ষে করে নেত্রীকে চিঠিও দিয়ে ছিলেন। ফল কি হয়ে ছিল তা সহজেই অনুমেয়।

সেই সময় বাজারী কাগজওয়ালাদের খবরের বিষয়বস্তু ছিল গড়বেতার চাঁদাই গ্রামের আর এক চম্পলা সর্দার মঞ্জু বারিক। খবরওয়ালাদের ডাকে তাকে প্রায়ই ক্যামেরার সামনে হাজির হয়ে সি পি এম-এর অত্যাচারের গুল্প(গল্প) শোনাতে হত। এমনকি কিভাবে সি পি এম-এর লোকেরা লাথি মেরে তার গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট করে ছিল-তা জানতে ভারতের কারও বাকি ছিলনা। বর্তমান ও আনন্দ বাজারে তখন দৈনিক বিজ্ঞাপণের মতো মঞ্জু বারিকের গুল্প ছাপা হতো। কিন্তু তারপর? কি বলে ছিলেন মঞ্জু বারিক?

"আমায় শেখানো হয়ে ছিল সি পি এমের নামে ওসব না বললে স্বামীকে মেরে ফেলা হবে-ইজ্জত লুট করবে।"

আর সন্তান নষ্ট? "হ্যাঁ সে তো অনেক দিন আগে। পুকুর পাড়ে জল আনতে গিয়ে পড়ে গিয়ে...।"

কেশপুর শেষ হয়নি আজও এনারা বেঁচে আছেন। হয়ত এখনও ভুগছেন আত্মগ্লানিতে...

বেঁচে আছেন মহম্মদ রফিকও। হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ-এর কলমে কোনো দিন হয়ত 'বাপ কা ব্যাটা-র ছবি দেখা যাবে।

এখানেই শেষ নয়। তৃণমূল কম্পানী আরও দিচ্ছে...

২০০০-সালের নভেম্বরে দিন পনেরোর জন্য পাঁশকুড়ার নেড়াদেউল থেকে সি পি এম-এর হাতে অত্যাচারিত কিছু অহিংস যোদ্ধাকে এনে রাখা হলো ময়দান চত্বরে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে। কুমারী ব্যানার্জীর চেয়ে ছিলেন প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যদি আবার একটা ২১শে জুলাই পাওয়া যায়। কিন্তু রাজ্য সরকার সে ফাঁদে পা না দিয়ে তৃণমূল নেতৃত্বকে আলোচনায় বসার আবেদন জানায়। আলোচনায় বসার অসুবিধা ছিল, পাছে ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরা নিশ্চিত হয়ে যায়! এক দিকে সরকারের লাগাতার আবেদন অন্য দিকে শিবির চালানোর খরচ। এই দুয়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে-রণে ভঙ্গ দেয় নেত্রী।

যারা এতোদিন নেত্রীর উস্কানিতে দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধের সেনানী হয়ে ছিল। যাদের মুখে মুখে ঘুরত নেত্রীর বাণী-

"সি পি এম-কে ভূতের নাচন দেখিয়ে দেব।"

"সি পি এম কর্মীদের হাত-পা কেটে নিন, তাতে কারো কিছু হলে আমরা দেখে নেব।"

"চমকাই তলায় চমকে দেব।"

শেষ পর্যন্ত ঘরছাড়াদের নিজের উদ্যোগেই ঘরে ফিরতে হয়।

রণে ভঙ্গ দিয়ে তো পালালেন। কিন্তু আপনারদের মিথ্যের কি হবে? সেদিন যে কোনো সংবাদ মাধ্যম নেত্রীর কাছে একটা প্রশ্ন উত্তরের আশা না রেখেই করতে পারতো যে, লোকসভা নির্বাচনে যে জায়গা থেকে তৃণমূল-বি জে পি জোট ৬৬৮টি ভোট পেয়েছে আর সি পি আই পেয়েছে ৩টি-সেখানে কোন সায়ন্টেফিক কায়দায় এতোগুলো যোদ্ধাকে সি পি এম ঘরছাড়া করতে পারলো? না মিডিয়া এমন কোনো প্রশ্ন করেননি। সত্য জানালে ভাঁড়ারে টান পরবে বলেই বোধহয় জানাতে বা জানাতে চায়নি।

কথায় বলে- 'টাকার কাছে ভগবানও নাচে'। ভগবান থাকলে কি করতো তা জানা না গেলেও যারা ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় পায়না তারা বা তাদের মতো আরও যারা আছে, তারা কি করে তা জানা যায় বারে বারে।

যেমন ২০০০ সালের ১৪-ই সেপ্টেম্বর বেলেঘাটায় তৃণমূল কর্মী গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে প্রেস স্টিকার লাগানো গাড়ি ভাঙ্গা হ'ল-সে খবর কিভাবে লেখা হয়েছিল তা সবাই জানে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কটাক্ষ করে বলে ছিলেন, "আঘাত সে যে পরশ তব সেইতো পুরস্কার।"

একাদশী সেরে ওঠা সাংবাদিক এমন কথাও লিখলেন যে, তৃণমূলের পতাকা হাতে সি পি এম সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে। মহাশয়, আপনার যে, সাংবাদিক মার খেলেন তিনি কি এমনই রিপোর্ট করে ছিলেন? নাকি আপনি পরম মমতায় তার কপালে রসকলি এঁকে শুনিয়ে ছিলেন- মেরেছে(ছো) কলসীর কানা, তা বলে কি প্রেম দেবে(ব)না?

তবে এনাদের মাঝে মাঝে নিজেদের থুতুই চাটতে হয়। যেমন হয়ে ছিল ২০০০-সালের ২রা এপ্রিল তৃণমূল কাউন্সিলর বিকাশ বসু হত্যাকান্ডে।

 

অথবা ২২শে জুন ২০০০।

আনন্দবাজার পত্রিকা লিখলো-"দিনভর অটলকে আর্জি জানিয়ে মমতার বাজিমাৎ, ৬টি শিল্প বন্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত"। সেই আনন্দবাজারকেই ১লা জুলাই ২০০০-এ লিখতে হলো-লিসবন থেকে দিল্লি ফেরার পথে প্রধানমন্ত্রী জানালেন, '৬টি শিল্প বন্ধের সিদ্ধান্ত নিইয়ে মমতা ব্যানার্জীকে কোনো প্রতিশ্রুতি কখনই দেওয়া হয়নি"

তবে কেন এমন কথা লেখা হয়েছিলো আট দিন আগে? যে সময় একথা লেখা হয় তখন ছিলো ভোটের প্রচার। সত্যিটা বেরলো প্রচার পর্ব শেষ হয়ে যাবার পর। ততদিনে মমতা ও এবিপি-র যৌথ প্রয়াসে কার্যসিদ্ধি হয়ে গেছে।

 

২রা আগস্ট ২০০০।

বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় গোঘাটের এক জনসভার কথা লেখা হলেও-পিছিয়ে যাতে না পরতে হয় সেই জন্যই হয়ত আনন্দবাজার লিখল- 'ডাকাতদের রানী মমতাই অশান্তির বীজ'-বলে একটা কথা তৎকালীন সি পি আই(এম)এর রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের মুখে বসানো হলো। সেদিনই অনিল বিশ্বাস প্রতিবাদ পত্র পাঠালে-পরের দিন ঐ পত্রিকার ৪র্থ পাতায় দৃষ্টির অগোচরে রাখা যায় এমন অক্ষরে 'দুঃখপ্রকাশ'-করা হয়।

 

বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধিতা মিডিয়ার দিক থেকে নতুন কিছু নয়। এই ষড়যন্ত্র চলছে তো চলছেই-আগামি দিনেও যে চলবে তা আজই নিশ্চিত করে বলা যায়।  সাংবাদিকতার বোরখায় মুখ ঢেকে মিডিয়া সন্ত্রাস যে কেমন তার সবচেয়ে ভালো জানা গিয়ে ছিল-

 

২৪শে জানুয়ারী-২০০০- বর্তমান পত্রিকা-

"যে গৃহযদ্ধ শুরু হয়েছে, বাঁকুড়া, বর্ধমান,মেদিনীপুর,হুগলী, ২৪-পরগনায়, তা গ্রাস করবে তামাম পশিমবঙ্গকে"

৯-ই ফেব্রুয়ারী ২০০০। বর্তমান পত্রিকা-

'জেলায় জেলায় আগুন জ্বলছে, সেই আগুনের অক্ষরেই লেখা হচ্ছে সি পি এম-এর শেষ অধ্যায়ের দিনলপি। লোহা গরম থাকতেই আঘাত করা উচিৎ'

কারা বলছেন এসব কথা? কাদের উদ্দেশ্যে এই ভবিষ্যৎবাণী? কিসের পরামর্শ? সংবাদপত্রের ভাষা এমন হতে পারে? এমন দলীয় নির্দেশনামা ছাপানোর পরও বলা হবে পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র নেই? কেশপুরকে কাশ্মীরের সাথে তুলনা করা হবে? তৃণমূলী বন্দুকবাজদের 'মুক্তিযোদ্ধা' বলা হবে-আর তাদের গুলিতে বামপন্থীরা মরলে অর্ন্তদ্বন্ধ বলে চালানো হবে?

 

 আসল সত্যি তো সেদিনই জানা হয়ে গিয়ে ছিল। যেদিন বলপুরের প্রকাশ্য জনসভায় মমতা ব্যানার্জী পরিস্কার বলে ছিলেন-

"পশ্চিমবঙ্গে ৩৫৬ ধারার লক্ষ্যে সাংবাদিকদের দিয়ে লেখাচ্ছি, ছবি তোলাচ্ছি"। দিনটা ছিল ২৯শে জুলাই ২০০০।

২০০০-সালের শেষ পর্ব শেষ হবেনা, যদি না ১৫-ই জুলাই ২০০০-এ আনন্দবাজারের প্রথম পাতার সেই ছবির কথা না মনে করিয়ে দিই-

কুঁড়ে ঘর মাটির দেয়াল, দেয়ালে তৃণমূলের প্রতীক চিহ্ন সহ ভোটের আবেদন। উঠোনে উলঙ্গ এক শিশুর পাশে দাঁড়িয়ে মহার্ঘ সালোয়ার কামিজে সুসজ্জিতা প্রসাধনে লালিত এক আধুনিকা শ্যাম্পু বাহার চুল উড়িয়ে মুখ ঢাকা এক যোদ্ধার হাতে তুলে দিচ্ছে অস্ত্র।

যিনি অস্ত্র দিচ্ছেন তার মুখ খোলা আর যাকে দেওয়া হচ্ছে তার মুখ ঢাকা কেন?  সে রহস্য পরে প্রকাশিত। 

ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks