Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

না-মানুষের উপকথা - সুদীপ্ত চক্র

স্কুল থেকে ছেলেফিরতেই বুকেরভিতরটা কেমনযেন কেঁপেউঠলস্কুলের সাদাজামাটায় লালছোপ ছোপদাগ, চুলগুলোসব এলোমেলো কাঞ্চনদৌড়ে গিয়েজড়িয়ে ধরেছেলেকে
- কি হয়েছে বাবা? জামায় এতরক্ত এলোকোথা থেকে!
ছেলে চুপ করেথাকে
কাঞ্চন কি বলবেভেবে পায়নাতার ছেলেতোএমন নয় শান্তস্বভাবের ছেলেরআজ হঠাত্ কি হলো ! ভেবে পায়না কাঞ্চন
- কি হয়েছে বাবাবল আমায়, কেউ কিতোকে মেরেছে? রাস্তায় কোন দুর্ঘটনা হয়েছে ? চুপকরে থাকিসনা বলআমায়
না কিছু হয়নি, কেউআমাকে মারেনি, আমিই ওদেরকেমেরেছি
- কাকে মেরেছিস বাবা? কেন ?
- ওই ওদেরকে যারাতোমার নামেবাজে কথাবলে, তাদেরকেমেরেছিকেন ওরাতোমাকে নিয়েবাজে কথাবলবে, মজাকরবে, তাইমেরেছি
- না বাবা ওরকমমারামারি করতেনেইওরা যদিআমার নামেকিছু বলেমজা পায়তো পাক তুমিতোআমার সোনাছেলেঅমন করেনা বাবা
- বেশ করব, আবারবললে আবারমারব
কোন রকমে ছেলেকেশান্ত করেখাইয়ে ঘুমপাড়িয়ে দেয়
এখন অসহ্য গরমেরজন্য স্কুলেরসময় সকালেকরে দিয়েছে স্কুলফেরত ছেলেকেনিয়ে তেমনসমস্যায় পড়তেহয় না কিন্তুআজ যেনসবকিছু এলোমেলোহয়ে যাচ্ছে
যে কথাটা সবসময়ছেলের কাছথেকে আড়ালকরতে চেয়েছতা যেনহঠাৎ করেসামনে চলেআসার উপক্রমহয়েছে
কার কাছে অভিযোগজানাবে কাঞ্চন! ভগবান ! সে তো তাকে আগেইমেরে রেখেদিয়েছেকি করবেসে ! নিজেরভাগ্যকেই অভিসম্পাতদিতে ইচ্ছাহয় তার
গরমের এই অলসদুপুরে ক্লান্তিনেমে আসেতার চোখে
নিজের মনে মনেইবলে যে
- জানিনা আর কতদিন এভাবেলুকিয়ে বেড়াবো
বাড়ি থেকে বেশকিছুটা দূরেস্টেশন সংলগ্নবাজারে তারনিজস্ব দোকান দোকানমানে ছোটবিউটি পার্লার প্রধানতমেয়েদের জন্যেইএই পার্লারতবে মাঝেমধ্যে বেলারদিকে পাড়ারকিছু উঠতিদাদাদেরও চুলদাড়ি সাফকরার ব্যবস্থাকরে দিতেহয়যা আয়হয় তাতেছেলেকে নিয়েমোটামুটি চলেযায় তার
প্রথম যখন তল্লাটে আসেতখন এইগ্রামের কিছুছেলেরাই তাকেসাহায্য করেছিল সাথেদুধের শিশুকেদেখে অনেকেভেবেছিল কাঞ্চনহয়তো বাচ্চাচুরি করেপালিয়ে এসেছে তাদেরমধ্যে কেউহয়তো পুলিশেখবর দিয়েছিল পুলিশএসে খোঁজখবরও করেকিন্তু সন্দেহজনককিছু নাপেয়ে আরবিরক্ত করেনি
শত চেষ্টাতেও সেতার পরিচয়পুরোপুরি আড়ালকরতে পারেনাগ্রামের গুটিকয়েকছেলে তারঅতীতের কথাশুনে তারদিকে সাহায্যেরহাত বাড়িয়েদিয়েছিল
কাঞ্চন একটু অবাকইহয়েছিল, কারণতার মতোমানুষদের কেউমানুস বলেগণ্য করেনা হয়সবাই একটুএড়িয়ে যায়, না হয়কটুক্তি করেজীবন দুর্বিসহকরে তোলে
আজ প্রায় দশবছর হয়েগেলতার এইতল্লাটে আসা ফেলেআসা দিনগুলোসে মুছেফেলতে চায়তার জীবনথেকে কিন্তুতবুও মাঝেমধ্যে কিছুঘটনা তারমনকে খুঁচিয়েরক্তাত্ত করেতোলে এইআজ যেমনহলো
- নাঃ এবার থেকেআরো সাবধানেপা ফেলতেহবে, ছেলেটাকেমানুষ নাকরা পর্যন্তশান্তি নেই, মনেমনে ভাবেসে
স্কুলের এই ঘটনারপর পেরিয়েগেছে আরোকিছু বছর
মাথার চুলে পাকধরেছেছেলেও স্কুলেরগন্ডি পেরিয়েকলেজ জীবনেপ্রবেশ করেছে আরমাত্র একটিবছর তারপরকলেজ জীবনেরওসমাপ্তিতারপর ছেলেরভাগ্য যেখানেনিয়ে যাবে কাঞ্চনমনেমনে ভেবেরেখেছে ছেলেকিছু কাজপেলেই একটাভালো মেয়েদেখে ছেলেরবিয়ে দিয়েযে চলেযাবে বহুদূরে,তাদেরজীবন থেকেসরে যাবেসেতার অভিশপ্তজীবনের ছায়াযেন ছেলেরবাকী জীবনেরউপর নাপরেচলে যাবেসে, অনেকঅনেক দূরে
ছেলের কলেজ সকালে, তাই দুজনেইএকসাথে বাড়িথেকে বেড়োয় আবারদুপুরে কলেজশেষ করেছেলে এলেদুজনে একসাথেবাড়ি ফেরে স্টেশনথেকে তাদেরগ্রাম ময়নাদীঘিরদূরত্ব দুইকিলোমিটার মতো হবে দুজনেগল্প করতেকরতে এইপথটুকু চলেআসেসকাল থেকেকি কিকরেছে, কলেজেকি কিহয়েছে, সবকথা তারআমু কেবলা চাই
হ্যাঁ ছোটবেলায়কথা বলতেশেখা থেকেইসে কাঞ্চনকেআমু বলেইডাকেকাঞ্চন ছেলেকেযখন যেনামে পারেডাকে, কখনওবলে সোনাবাবা কখনওমিষ্টু আবারকখনও শুধুজয়ছেলের নামএকটা দিয়েছে বাইরেরসবাই ওকেজয়জীৎ নামেইচেনে
বাবার নাম হিসাবেখাতায় কলমেমনি বসুনামটাই আছে যদিওজয়জীত্বাবাকে বাবাবার কোনছবি কখনওদেখেনিআমু বলেওর ছোটবয়েসেই নাকিউনি আমুকেছেড়ে চলেযানআমুই ওকেএকা এতবড় করেতুলেছে
দুপুরে খেতে বসেআমুর সাথেগল্প করতেকরতে একএকদিন অনেকবেলা হয়েযায়সব কাজগুছিয়ে আমুছোটে দোকানে ফিরতেফিরতে সেই'টাবেজে যায়
জয়জীৎ এটুকু সময়একাই থাকেনিজের পড়াশুনানিয়েএই একটাকাজে কখনওসে ফাঁকিদেয়নিসে ভাবেকলেজ শেষকরে একটাচাকরী পেলেসে আরআমুকে কাজকরতে দেবেনা
এভাবেই চলতে থাকেতাদের দৈনন্দিনজীবন
কাঞ্চন বেশ কিছুদিনধরে তারমিষ্টুর হাবভাবেকিছু পরিবর্তনলক্ষ্য করছে মিষ্টুকিছু যেনবলতে গিয়েওবলতে পারছেনাএকটু চিন্তায়পড়ে যায়সেকি হলোছেলের ! আগেরমতো তোআর সেভাবেতার সাথেগল্প করেনা, একটুযেন আনমনাথাকেছেলে কিতার সম্বন্ধেকিছু জানতেপারল ! কিন্তুসেরকমও তোকিছু আভাসপাওয়া যাচ্ছেনা, তাহলে! কাঞ্চন ভাবলদেখি কিছুদিনতারপর নাহয় ছেলেকেজিঞ্জাসা করব
কয়েকদিন পর কলেজথেকে ফিরেখাওয়ার সময়জয়জীত্বলল
- আমু, খাওয়ার পরআমি একটুবেড়বো, সন্ধ্যারমধ্যে ফিরেআসব খুববেশী হলেসাতটা বাজবে
কাঞ্চন ছেলেকে আড়চোখেদেখে বলে- কোথায় যাবিরে ?
- সেরকম কোথাও না, কলেজের একবন্ধু কিছুমার্কেটিং করবে তাই তার সাথেআমাকে যেতেবলেছে
- তাড়াতাড়ি ফিরিস দেরীকরিস নাযেন
- না না দেরীহবে না
খাওয়ার পর জামাপ্যান্ট পড়েতৈরী হয়েজয়জীত্বলল
- আমু আমি আসছি
কাঞ্চন হেসে বলল
- তা হ্যাঁ রেমিষ্টু মেয়েটারসাথ আমাকেআলাপ করাবিনা ?
জয়জীত্ তার আমুর এই অতর্কিতআক্রমণে হতবম্ভহয় গেল আমতাআমতা করেবলল
- না মানে মেয়েকোথায় পেলে! আমিতো যাচ্ছিএক বন্ধুরসাথে
- মেয়ে পেলাম তোরপকেটে
- মানে ?
- আজ সকালে প্যান্টকাচার সময়প্যান্টের পকেটে একটা চিরকুট পেলাম, লেখাছিল যে" বড় ঘড়ির নিচে আমি অপেক্ষাকরব ঠিকচারটের সময়দেরী করোনা"- এবার মানেটাতুই বল
না মানে আমুআমি তোমাকেবলতাম বিশ্বাসকরো
- দেখ বাবা তুইএত লজ্জাপাচ্ছিস কেন? যদি কাউকেভালোবেসে থাকিসতো ক্ষতিকি ? একদিননিয়ে আয়তাকে
- আমু তুমি রাগকরনি তোআমার উপর?
- দূর পাগল, রাগকরব কেন? আর এইনে এইটাকাটা রাখ,কিছু কিনেদিস ওকে, যা হোককিছু বলবিআমু দিয়েছে
ছেলে হাসিমুখে চলেযায়
কাঞ্চন ভাবে নাআর বেশীদেরী নয়এবার ছেলেকেনিজের আসলরূপ,আসলপরিচয় জানানোরসময় এসেছে
ঠিক সন্ধ্যার মুখেছেলে ফিরেএসে পার্লারেউঁকি মেরেবলে আমুআমি চলেএসেছিতোমার হয়েগেলেতুমি তাড়াতাড়িবাড়ি চলেএসো, আমিবাড়ি চললাম
কাঞ্চন ছেলের হাসিমুখটারদিকে তাকিয়েথাকে
ছেলে চলে যেতেইভাবতে থাকে
কি বলব ছেলেকে? সে যদিসবকিছু জেনেঘেন্না করেআমাকে, কিকরব আমি? নাঃ ছেলেরকলেজ শেষহোক তারপরনা হয়সব জানিয়েআমি দূরেসরে যাব
রাতে বাড়ি ফিরেছেলের হাসিমুখদেখে মনভরে গেলকাঞ্চনের
খেতে বসে ছেলেবলল
- জানো আমু তোমারদেওয়া টাকাদিয়ে ওকেকিছুই কিনেদিতে পারলামনা
- সে কি রেআমি যেবললাম কিছুকিনে দিস! সত্যি তুইনা একটাযাচ্ছেতাই
- তুমিও বলছ আমিযাচ্ছেতাই !
মৌ কে দুপুরেরকথা বলেবললাম আমুএই টাকাটাদিয়েছে বলেছেতোমায় কিছুকিনে দিতে মৌটাকাটা আমারহাত থেকেকেড়ে নিয়েবলল, তুমিএকটা যাচ্ছেতাই আমুরদেওয়া এইটাকাটা কেউখরচ করে! ওটা আমারকাছে রাখাথাক, ওতেআমুর আর্শীবাদআছে যে
- মৌ ! ওর নামবুঝি মৌ?
- হ্যাঁ, ওর ভালোনাম মৌমিতা খুবভালো মেয়ে আমাদেরকলেজেই ভর্তিহয়েছেআমাদের স্টেশনেরদুটো স্টেশনআগে যেগ্রাম সেখানেইথাকে
- তাই না কি?
- হ্যাঁ আমু, জানোওরও বাবানেই, ওরমাও অনেককষ্ট করেওকে বড়করে তুলেছে
- তা হ্যাঁ রেওদের চলেকি করে?
- ওর বাবা মারাযাওয়ার পরওদের ভাগেকিছু জমিপড়েছিল,ওইজমি থেকেযেটুকু আয়হয় তাতেইমা মেয়েরচলে যায়কোন রকমে
- মৌ-এর সাথেআমার আলাপকরাবি না? নিয়ে আয়না একদিনওকে
- নিয়ে আসব আমু, একদিন ঠিকনিয়ে আসব
ভাবেই ছেলেকে নিয়েকাঞ্চনের কেটেযায় আরোকিছুদিনতার মনকিন্তু দোলচালেথাকে, কিভাবেছেলেকে জানাবেতার জীবনেরইতিকথা ! মনেরমধ্যে টানাপোড়েনচলতেই থাকে
আজ সকাল থেকেইগুমোট গরম, চারিদিকে দমবন্ধকরা পরিবেশ আগেরদিন রাতেকয়েক ফোঁটাবৃষ্টি হওয়ারজন্য সকালথেকেই বাতাসভারী হয়েআছেছেলে কলেজযাওয়ার পরআজ পার্লারেএসেছে সে শরীরটাঠিক ভালোলাগছেনা কাঞ্চনের দোকানখুলে বাইরেবসেই কাটিয়েদিয়েছে কিছুটাসময়প্রকৃতির এইমুখভার করাআবহাওয়ায় বাজারতেমন জমেওঠেনিলোকজনের আনাগোনাআজ কমদোকানেরবাইরে বসেকাঞ্চন স্টেশনেরদিকে আলগাচোখে তাকিয়েছিল আরকিছুক্ষণ পরইছেলে ফিরবেকলেজ থেকে হঠাৎযেন ভুতদেখার মতোচমকে ওঠে তারমনে ছেলেরসেই স্কুলেরদিনের ঘটনাভেসে ওঠে চমকেতাকিয়ে দেখেছেলে স্টেশনেরসিঁড়ি ভেঙেনেমে আসছে, গায়ের জামাটায়রক্তের দাগ, পা একটুটলমল করছে কাঞ্চনছুটে যায়ছেলের কাছে-
- কি হয়েছে মিষ্টু, এত রক্তকেন ?
- কিছু হয়নি, সরেযাও তুমি
- কিছু হয়নি! বললেইহবে !
তাড়াতাড়ি পার্লার বন্ধকরে ছেলেকেনিয়ে রিক্সায়উঠেবসে, সোজাচলে আসেহারাণ ডাক্তারেরবাড়িহারাণ নামেইডাক্তার, ডাক্তারিপাশ করারকোন প্রমাণনেই মানেহাতুড়ে আরকি, তবেঅসময়ে হারাণডাক্তারই এখানকারমানুষের কাছেভাঙা কুলো ডাক্তারছেলের মাথায়ওষুধ লাগিয়েব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিতেই কাঞ্চন ছেলেকেনিয়ে বাড়িচলে আসে
ছেলের গায়ে মাথায়হাত বুলিয়েবলে
- বলনা বাবা কিহয়েছে ? কিকরে এমনহলো ? তুইকি আবারকারও সাথেমারামারি করেছিস? কেন বাবা?
- বেশ করেছি, দরকারপড়লে আবারকরব
- ছিঃ মিষ্টু, অমনবলেনা বাবাকেনশুধু শুধুএসব করিস!
- শুধু শুধু !
- কি হয়েছে আমায়বল বাবা
- কি হয়েছে ! যাহয়েছে সবতোমার জন্যআমু
- আমার জন্য !
- হ্যাঁ তোমার জন্য, ওপাড়ার পিন্টুরসাথে আজট্রেনে বসারজায়গা নিয়েকথা কাটাকাটিহতেই তোমারনামে বাজেকথা বলতেলাগলআমি সহ্যকরতে পারিনিআমু
- যে যা বলেবলুক না, তুই কেনমারামারি করতেযাস বাবা
- যা হয়েছে সবতোমার জন্যআমু, সবতোমার জন্য কেনতুমি এইরকমআমু ? কেনতোমার কথাবার্তা, চালচলন সাধারণলোকের মতোনয় ? কেনকেন ? কেনতুমি আমাকেআমায় আমারবাবার কথাবল না? কেন তুমিসব সময়এড়িয়ে যাও?
- একটু শান্ত বাবা
- শান্ত হব ! সবঅশান্তির মূলেতো তুমিআমুসেই ছোটথেকে স্কুলেকলেজে সবারকাছে হাসিরপাত্র হয়েগেছিআমিআর কতশান্ত হয়েথাকব আমু!
হতবাক হয়ে যায়কাঞ্চন, কিন্তুআশ্চর্য হয়নাসে জানতএমন দিনএকদিন নাএকদিন আসবেই
- মিষ্টু আমার কথাএকটু শোনবাবা
না আমু আরনা, এখানেথাকলে আমিপাগল হয়েযাবতোমার সাথেআর একমুহুর্তথাকা সম্ভবনয়
- না বাবা এভাবেবলিস না, তুই ছাড়াআমার আরকে আছেবল ! যাসনা সোনাআমার দু-হাতেজড়িয়ে ধরেছেলেকে
- হঠাৎ কাঞ্চনের মাথাটাদুলে ওঠে কোনরকমে দরজাটাআঁকড়ে ধরেবলে যাসনা বাবা, ধীরে ধীরেঅন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতেথাকে

কপালে নরম ঠান্ডাহাতের পরশপেয়ে ধীরেধীরে চোখমেলে কাঞ্চন চোখেরসামনে দুটিমায়াবী চোখদেখে সে মিষ্টিমুখের মেয়েটিতার মুখেরউপর ঝুঁকেপরে কপালেহাত বুলিয়েদিচ্ছেকাঞ্চন উঠেবসতে চায়
হালকা শাসনের সুরেমেয়েটি বলেওঠে
- না এখন একদমউঠবে নাআমু, চুপটিকরে শুয়েথাক
- তুই কে মা? মৌ ?
- হ্যাঁ আমু আমিমৌ ?
- আমার মিষ্টু কোথায়?
দুটি চোখ এদিকওদিক খুঁজেফেরে, দেখেদরজার পাশেমাথা নিচুকরে বসেআছে সে দু-চোখে জলেররেখা
- ওখানে কেন বসেআছিস ? আয়বাবা আমারকাছে আয়
- না ওখানেইবসে থাকুক, যে আমুকেকষ্ট দেয়তার এখানেআসার দরকারনেই
- দূর পাগলী মেয়ে, ছেলের কথায়আমুর কোনকষ্ট হয়না রেমাতাছাড়া তুইতোআছিস, আমারসব কষ্টভুলিয়ে দিবি
- এই যে শুনতেপাচ্ছ ? আমুডাকছেসত্যি তুমিপারও বটে,যাচ্ছেতাই ছেলে একটা
হেসে ফেলে কাঞ্চন
- আয় বাবা কাছেআয়
ছেলে ধীরে ধীরেএগিয়ে এসেতার আমুরপা দুটিজড়িয়ে ধরে, দু ফোঁটাচোখের জলপায়ে ঝরেপড়েছেলের হাতধরে কাঞ্চনতাকে কাছেটেনে নেয়
- আয় এখানে বোসবাবাতোরা দুজনেইআমার কাছেবসতোদের কিছুকথা বলারআছে আমার তোদেরআজ আমিএকটা গল্পশোনাব
সেদিন সকাল থেকেঅঝোর ধারায়বৃষ্টি পড়ছে বোসবাড়ির একমাত্রবৌমা প্রসবযন্ত্রনায় কাতর বাড়ির একমাত্রছেলে সুধীরবোস, তারবউ সবিতারসন্তান প্রসবহওয়ার সময়হয়ে এসেছে তখনকারসময়ে ডাক্তারেরএত চলছিল নাআঁতুরঘরে দাইমারাইসব সামলেনিতবোস বাড়িরআঁতুর ঘরেদাইমা উপস্থিত একটুবারবেলার দিকেসবিতার সন্তানপ্রসব হলো দাইমাএসে খবরদিল ছেলেহয়েছেবোস বাড়িতেখুশির আমেজবয়ে গেল বড়কত্তারআনন্দ দেখেকে,তার ছেলেসুধীর আরবৌমা সবিতারছেলে হয়েছেযে, ঘরেনাতি এসেছে বড়কত্তাআদর করেনাম দিলমণিকাঞ্চন, তার আদরের মণি
ছেলে ধীরে ধীরেবড় হতেথাকে, যতক্ষণজেগে থাকেসারা বাড়িমাতিয়ে রাখে
প্রথম প্রথম কেউকিছু বুঝতেপারে নি, একটু বড়হতেই মা-এর চোখেপ্রথম ধরাপড়েছোট থেকেইমণি একটুমেয়ে ঘেঁসা বাড়িরমেয়েদের সাথেসময় কাটাতেভালোবাসতোএকদিন দুপুরবেলাবাড়ির সবকাজ গুছিয়েমা যখনশোয়ার ঘরেএল তখনদেখে মণিতার এককাপড় পড়েছে, আয়নার সামনেদাঁড়িয়ে সাজতেব্যাস্ততখন তারকত আরবয়স হবেএই নয়কি দশবছর
মাকে দেখে একটুথতমত খেয়েযায় মণি মাজিঞ্জাসা করে
- মণি আয়নার সামনেদাঁড়িয়ে কিকরছিস ? আরশাড়ি পরেছিসকেন?
- না মা কিছুনা, আমারনা তোমারকাপড় পরতেতোমার মতোসাজতে খুবইচ্ছা করে
- না বাবা ছেলেদেরএসব করতেনেই, লোকেনিন্দা করবে
- কিন্তু আমার যেভালেলাগে
- না বাবা আরকোনদিন এরকমকরো না, আমি যেনআর কোনদিনএরকম সাজেতোমায় নাদেখি
সেদিন হয়তো ভগবানঅলক্ষ্যে হেসেছিলেন
এরপর মণির বয়সযত বাড়তেথাকে তারকথাবার্তা, চালচলনে মেয়েলী ভাব ততপ্রকট হতেথাকে
স্কুলের বন্ধুরা, পাড়ারছেলেরা তাকেদেখলেই নানাকটুক্তি করতেথাকেকিন্তু তাতেমণির কিছুযায় আসেনা, সেনিজেকে নিয়েইবিভোর হয়েথাকে
এভাবেই স্কুলের গন্ডীপার করেসেবিপত্তি বাঁধেতারপরধীরে ধীরেসে নিজেকেচার দেওয়ালেরমধ্যে আবদ্ধকরে ফেলে মা-এর গোপনবাক্স থেকেটাকা চুরিকরে কিছুমেয়েদের পোশাককিনে এনেছিল সেইপোশাক পড়েঘরের মধ্যেইঘুরে বেড়ায়
যে বড়কত্তা একদিনআদর করেতার নামরেখে ছিলেন, তিনি এখনমণিকে দুচোখে দেখতেপাড়েন না বাবারকাছে যাওয়ারসাহস পায়নামণিএই পোশাকেবাবা একদিনদেখে ফেলেছিল, তারপর মারেরচোটে দুদিনবিছানা ছেড়েউঠতে পারেনিসে
মা বোঝেন, সবকিছুধীরে ধীরেহাতের বাইরেচলে যাচ্ছেতারএকমাত্র সন্তানকে ডাক্তরেরকাছেও নিয়েগিয়েছিল কিন্তুলাভ কিছুহয়নি
মা সবার অলক্ষ্যেচোখের জলফেলেনচেষ্টা করেনসবার থেকেছেলেকে আগলেরাখতে
মা ভেবে পাননা ছেলেকেকি বলেডাকবেন , ছেলেবলবেন ? মেয়েবলবেন ? কিবলবেন ওকে?
সমাজ যে নামেওদের মতোমানুষদের কেডাকে সেইনাম মুখেআনতেও কষ্টহয় তার
আর মণি ! ধীরেধীরেসেও বুঝতেপারে প্রতিনিয়তবদলে যাচ্ছেসে
বদলে যাচ্ছে তারদেহের বিশেষঅঙ্গ, বদলেযাচ্ছে তারমনঅসহনীয় কষ্টেবন্ধ ঘরেরদেওয়ালে মাথাঠোকে সেঅসহ্যলাগে তারচারপাশের মানুষজনকে, শুধুমা-এরজন্য কষ্টহয় কিন্তুকি করবেসে ! মায়েরজন্য তারতো কিছুইকরার নেই
অবশেষে একদিন সবারঅলক্ষ্যে ঘরছাড়ে সে ভিড়েযায় বৃহন্নলাদেরদলেতার তাকেসানন্দে বুকেটেনে নেয় গুরুজীমানে ওদেরদলপতির আর্শীবাদনিয়ে শুরুহয় তারনতুন জীবন মনেরকষ্ট কিছুটালাঘব হলেওপুরোপুরি সহজহতে পারেনাসেরাস্তাঘাটে মানুষের কটুক্তি পীড়া দেয়তাকে
এই বৃহন্নলা বস্তিতেআসার পর, দিনের কাজেরশেষে গুরুজীযেটুকু টাকাহাতে তুলেদেয় তাতেকিছুটা সেনিজের সখআহ্লাদ মিটিয়েনেয়, কিছুটাসঞ্চয় করেরাখে
প্রথম দিন তাকেদেখে গুরুজীবলেছিল - তুইযদি একটুসেজেগুজে বাইরেযাস তোতোকে চেনামুশকিল, অনেকছেলেই তোরপিছনে লাইনলাগাবে
মনির বাড়ির কথামনে পরে বাড়িতেসবাই বলতছেলে মায়েরমুখ পেয়েছে, মাতৃমুখী ছেলেরানাকি সুখিহয়এই কিসুখ ! মনেভাবে সে চোখেরকোনে একটুজল জমে
সেদিন বিকেলে বস্তিরকাছের বাজারেগিয়েছিল মণি কিছুকেনাকাটি করারছিলদোকান থেকেফেরার সময়হঠাৎ একটাজোড়ালো শিটিরআওয়াজ কানেএলকে যেনবলে উঠল
- ওই শ্রীদেবী চললিকোথায় ? কিমাঞ্জা দিয়েছিসমাইরি, কোননাগরের কাছেগিয়েছিলি ?
মণির কান মাথাগরম হয়েগেল, সে ফিরেতাকিয়ে বলল
- ছিঃ তোমরা এতখারাপ কথাকেন বলগো ! আমরাকি মানুষনই ! আমাদেরকি মনবলে কিছুনেই !
- হা হা হাহা ছক্কাটাকি বলেদেখ, নাকি মানুষ, আবার ওরনাকি মনওআছে ! হাহা হাহা , তামন কাকেদিলি সুন্দরী! হা হাহা হা
মণি চুপ করেযায়ওর দলেরঅন্য কেউহলে এখনিগালাগালি আরম্ভকরে দিতকিন্তু মণিরমুখ দিয়েওসব কথাবেড়োয় না
ওদের হাসির শব্দতার কানকে বিদ্ধকরেহায়নার আওয়াজেরসাথে ওদেরহাসির কোনতফাৎ খুঁজেপায় নাসে
এভাবেই কেটে যায়আরো কয়েকবছরনা বাড়িরকেউ আরখোঁজ করেনিতারতবুও মায়েরজন্য মনকাঁদে তার
সেদিন এক দুঃস্বপ্নদেখে শেষরাতেমা শ্বশানেচিতার উপরশুয়ে আছে, আগুনের শিখাধীরে ধীরেগ্রাস করছেমাকেঘুম ভেঙেযায় তার
দরজা খুলে বস্তিরঘরের বাইরেআসেভাবে একবারগিয়ে খবরনেবে কেমনআছে মা ঘড়িতেদেখে তিনটেবাজে, এখনবস্তির সবাইগভীর ঘুমে ভাবতেভাবতে বড়রাস্তা ধরেহাঁটতে আরম্ভকরে
কিছুটা যাওয়ার পরহঠাৎ তারকানে বাচ্চারকান্নার আওয়াজআসেকিছুটা এগিয়েগিয়ে দেখেরাস্তার ধারেঝোপের ভিতরথেকে কান্নারআওয়াজ আসছে চারিদিকেতাকিয়ে দেখেকিন্তু কোনলোকজন চোখেপড়ল না সেঝোপের দিকেএগিয়ে যায়দেখে একটাবাচ্চা কেউকাপড়ে জরিয়েফেলে দিয়েগেছেলাল পিঁপড়েতেছেঁকে ধরেছে, যন্ত্রনায় চিৎকার করছে বাচ্চাটামণির আরমায়ের কাছেযাওয়া হয়নাবাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে বস্তিতে ফিরেআসেবাচ্চাটার সারা শরীর পিঁপড়ের কামড়েলাল হয়েফুলে আছে ধীরেধীরে পিঁপড়েগুলো পরিষ্কারকরে নিজেরজন্য আনাক্রিম লাগিয়েদেয়বাচ্চাটা আরামপেয়ে একটুচুপ করেযায়মণি ভাবেকে এভাবেএই সদ্যজন্মানো এইফুলের মতোছেলেটাকে ফেলেদিয়ে গেল!
ধীরে ধীরে বস্তিরঘুম ভাঙে ভোরেরআলো ফুটেওঠেবাচ্চাটা একটুআরাম পেয়েমণির কোলেইঘুমিয়ে পড়েছে বাচ্চাটারমুখের দিকেতাকিয়ে থাকেমণি ভাবেকেন মানুষএত নিষ্ঠুরহয় ! যারাএই জঘন্যকাজ করতেপারে তারামানুষ ! আরআমরা বৃহন্নলারামানুষের শরীরনিয়েওনা-মানুষহয়েরয়ে গেলাম!
হঠাৎ বাচ্চাটা কেঁদেওঠে,হয়তোখিদের জ্বালায়কেঁদে উঠেছেসে, কিন্তুমণি কিকরবে ভেবেপায় না এদিকেবাচ্চার কান্নারআওয়াজ শুনেতার ঘরেভীড় জমায়সবাইনানা প্রশ্নকরতে থাকেসবাইমণি বলেসে বাচ্চাটাকুড়িয়ে পেয়েছে, কিন্তু বিশ্বাসকরতে চায়না কেউ শেষেগুরুজী আসতেসবাই চুপকরে যায় মণিসব কথাখুলে বলে গুরুজীবলল - ঠিকআছে তোরকাছেই এখনরাখ আরবাচ্চাটার জন্য একটু দুধের ব্যবস্থাকর, পরেচিন্তা করাযাবে বাচ্চাটাকেনিয়েএভাবে দিনদশেক পারহয়ে যায় মণিরবাইরে বেড়োনোবন্ধ হয়েযায়বাচ্চাটাকে নিয়েই কেটে যায় সারাদিন
এদিক ওদিক থেকেকিছু টুকরোকথা ভেসেআসে কানে কানাঘুষোয়মণি শুনতেপায় যেএই বাচ্চাটাকেএই সমাজেরউপযুক্ত করারতোড়জোড় চলছে এইকদিনেই নিজেরছেলের মতোভালোবেসে ফেলেছেমণিতার মনঅশান্ত হয়েওঠেনিজের মনেইবলে ওঠেসে
- না কিছুতেই আমি হতেদেব না একেবাঁচাতেই হবেকিছুতেই একে-মানুষহতে দেবনা, ওকেসম্পূর্ন মানুষকরে তুলব
https://jdelivery.rediff.com/ajaxprism/pix/grayblock.gifআমার ছেলেরপরিচয়েই বড়হয়ে উঠবেসেহয়তো তাতেনিজের  পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হবে,হয়তোসমাজের সাথেলড়াই করতেহবে, কিন্তুতাকে কিছুতেইএই বৃহন্নলাসমাজের একজনহতে দেবনা
সেই সেদিনের মতোশেষরাতে ছেলেকেনিয়ে বস্তিছাড়েসম্বল বলতেনিজের জমানোকয়েক হাজারটাকা,কিছুজামাকাপড় ব্যাসআর কিছুনা তারপরএশহর ওশহরঘুরতে ঘুরতেশেষে হাজিরহয় এইময়নাদীঘি গ্রামে কেনজানিনা এইগ্রামটা ভালোলেগেযায় তার
কয়েকদিন গ্রামের থেকেদূরে স্টেশনচত্বরে কাটিয়েদেয়লুকিয়ে ফেলেতার না-মানুষের পরিচয় তবুওগ্রামের দু-একজনের কাছেধরা পড়েযায়সবকিছু লুকিয়েফেললেও নিজেরকণ্ঠস্বর লুকোতেপারেনা সে কিছুটাছেলের জন্যবাধ্য হয়েইতাদেরকে নিজেরসব কথাখুলে বলে তারসব কথাশুনে কেনজানি নাতারা সাহায্যেরহাত বাড়িয়েদেয়
তার একসময়ের মণিকাঞ্চননামের থেকেমণিকে বাদদিয়ে তাকেনিরুদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়
গ্রামের সবাই জানলযে মণিবসু তারস্ত্রী কাঞ্চনবসুকে পরিত্যাগকরে নিরুদ্দেশহয়ে গেছেন
কাঞ্চন বসু তারছেলে জয়জীৎবসুকে নিয়েজীবনের লড়াইশুরু করে
এইটুকু বলে চুপকরে যায়কাঞ্চনসারা ঘরনিস্তব্দ্ধ মিষ্টু মৌ কারওদিকেই চোখতুলে তাকাতেপারেনা কাঞ্চন বুকেরভিতরটা কেমনযেন হালকালাগে তার
নরম হাতের স্পর্শপেয়ে চোখতুলে তাকায়, দেখে মৌ- এর চোখেজল টলটলকরছে, মিষ্টুমাথা নিচুকরে বসেআছেধীরে ধীরেউঠে দাঁড়ায়কাঞ্চনমিষ্টুর মাথায়হাত রেখেবলে - এইআমারনা-মানুষেরজীবনকথাতবে তুইচিন্তা করিসনাবাবা, তোরবাকী জীবনেরউপর আমিআমার ছায়াপড়তে দেবনাতুই তোরমনের সাথিখুঁজে পেয়েছিস, মৌ খুবভালো মেয়েআমি এবারনিশ্চিন্তে যেতে পারব তোরাসুখি হোসবাবা আরআমার এজীবনেকিছু চাওয়ারনেই
এতক্ষণে মৌ চিৎকারকরে বলেওঠে
- কোথায় যাবে তুমি? কেন যাবে?
- কোথায় যাবো জানিনারে মা, আর কেনযাবো ! কারণআমি চাইনা আমারএই অভিশপ্তজীবনের অশুভছায়া তোদেরবাকী জীবনেরউপর পরুক বাকীজীবনটাতে যেনতোদের কোনকটুক্তি শুনতেনা হয়
- অভিশপ্ত জীবন ! অশুভছায়া ! আমু, মা বাবারদুটো সত্ত্বাইযে তোমারমধ্যে একহয়ে আছেপুরাণেআছে অর্ধনারীশ্বর পুরুষনারী ছাড়াঅসম্পূর্ন, নারী পুরুষ ছাড়া অসম্পূর্ন কিন্তুতোমার মধ্যেযে দুজনেরইঅধিষ্ঠান, আমু তুমিই যে অর্ধনারীশ্বর তোমাকেবাদ দিলেযে মিষ্টুআমি আমরাদুজনেই অসম্পূর্নহয়ে যাব
মিষ্টুর চোখের জলবাঁধ মানেনা, কাঞ্চনকেএসে জড়িয়েধরে
- আমু তুমি আমারজন্মদাত্রী নও, তুমি যে আমারপ্রাণদায়িনী তোমার এই অশুভছায়াই যেআমার প্রাণশক্তি তোমারমতো সম্পূর্নমানুষকে আমিহারাতে চাইনাআমু
কাঞ্চন দুহাতে দুজনকেজড়িয়ে ধরে
গ্রামের এই ছোট্টঘরেঅর্ধনারীশ্বরের অদ্ভুত এক আলোছায়া জেগেওঠে
                  


                  ******* সমাপ্ত ********

ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks