Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

দলিত রাজনীতি এবং কমিউনিস্ট পার্টি - একটি আলোচনার সূচনা ~ পুরন্দর ভাট

সাম্প্রতিক উনাতে গোরক্ষা বাহিনীর হাতে দলিত নিগ্রহকে কেন্দ্র করে গুজরাটে এক ঐতিহাসিক দলিত - মুসলিম যৌথ আন্দোলনের সূচনা হয়েছে যার ফলস্বরূপ সারা গুজরাট জুড়ে বিশাল এক পদযাত্রার পর উনাতে পঁচিশ হাজার দলিতের সমাবেশ হয়েছে। সেখান থেকে ডাক দেওয়া হয়েছে ব্রাহ্মণবাদ আর তার তাঁবেদারি করা সংগঠনগুলি, বিশেষ করে সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার। একই সঙ্গে সোনি সোরির নেতৃত্বে ছত্তিসগড়ের আদিবাসী সম্প্রদায় বিজেপি সরকার আর তার আদিবাসী বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে পদযাত্রা করেছে। আগামী দিনে এই দুটো আন্দোলন একই বিন্দুতে এসে মিলবে বলেই মনে করি।  আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নিম্নবর্ণ, সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের ওপর ক্রমাগত শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে যার পুরোভাগে রয়েছে সংঘ পরিবার। এই আন্দোলনগুলোয় বিভিন্ন বামপন্থী দল নিজেদের সীমিত ক্ষমতায় পাসে থাকার চেষ্টা করছে, কোথাও কোথাও নেতৃত্বও দিয়েছে যেমন সিপিএম আম্বেদকর ভবন ভেঙে দেওয়ার বিরুদ্ধে ২০ হাজার দলিতকে নিয়ে মিছিল করেছে মুম্বাই শহরে যার চাপে মহারাষ্ট্র সরকার সেই ভবন পুনর্নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু বামপন্থীরা এই দলিত আদিবাসী নবজাগরণকে কি ভাবে নিজেদের তাত্বিক কাঠামোর সঙ্গে মেলাবে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যার বোধয় অভাব আছে। দলিত আদিবাসী আন্দোলনই যে ব্রাহ্মণবাদকে এই দেশ থেকে মুছে দেওয়ার একমাত্র পথ এই নিয়ে আমি নিঃসন্দেহ। কাজটা সোজা নয়, আরএসএস শুধু হিমশৈলীর চূড়া মাত্র, এই আন্দোলন ব্যাপ্ত হলে আরএসএস খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে কিন্তু তাতেই বর্ণবাদ শেষ হয়ে যাবে না, আরও অনেক দূর যেতে হবে তার জন্যে। তাই  বামপন্থীরা কী ভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আর কী ভাবে এই আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করতে পারে এই নিয়ে স্পষ্ট ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন। 

জেএনইউর "দেশদ্রোহী" উমার খালিদ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি অসামান্য প্রবন্ধ লিখেছেন টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। অমনোযোগী হয়ে লেখাটা পড়লে প্রবন্ধটির গুরুত্ব বোঝা যাবে না, আরো পাঁচটা ভালো প্রবন্ধের মতোই মনে হবে। আসল বক্তব্য প্রবন্ধটির একদম শেষে রয়েছে, হয়তো অনেকের নজরেও বিষয়টা পড়েনি কারণ কোথাও আলোচনা লক্ষ্য করিনি। উমার লিখছেন যে ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হতে চলেছে দলিত এবং আদিবাসীদের কেন্দ্র করেই। দলিত এবং আদিবাসীরা হাজার হাজার বছরের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে, সামাজিক ন্যায়ের জন্যে  আন্দোলন করবে এবং তাতেই আমাদের পুতিগন্ধময় সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এতে শুধুই দলিতরা মুক্তি পাবে তা নয়, তাদের আন্দোলনের ফলেই এই সমাজ এবং এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষিত সমস্ত মানুষই তাদের মুক্তির সন্ধান পাবে। যেটা উনি ব্যাখ্যা করেননি বিস্তারিতভাবে তা হলো যে বর্ণবাদ শুধুই দলিতদের শোষণ করে না। আমাদের সমাজে  নারীদের অবস্থানের পেছনেও সেই বর্ণবাদই দায়ী, শ্রমিক এবং কৃষককে যাঁরা শোষণ করে তাদের অধিকাংশও উচ্চবর্ণই। তাই বর্ণবাদকে মুছে দিলে বাকি শোষণগুলোর ওপরেও তার প্রভাব পড়বে। যাঁরা আমাদের দেশের বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলোর প্রোগ্রামের সাথে ওয়াকিবহাল তাঁরা হয়তো অনুধাবন করতে পারছেন উমার যা বলেছে তা কতখানি নতুন এবং ভারতের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর যে প্রোগ্রাম তার থেকে কতটা আলাদা। বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিচ্ছি। 

আমাদের দেশের সংসদীয় কমিউনিস্ট দলগুলোর মধ্যে প্রধান হলো সিপিএম এবং সিপিআই। এদের প্রোগ্রামে কিছু তফাৎ থাকলেও মূল জায়গায় ফারাক নেই। এই দুই দলই মনে করে যে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম লক্ষ্য হলো  ভারতে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করা। এই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব করবে  শ্রমিক-কৃষক জোট, তারাই হবে বিপ্লবের চালিকাশক্তি। তারা মনে করে যে  জোটটা শ্রমিক-কৃষকের হলেও শ্রমিক শ্রেণীই থাকবে পুরোভাগে কারণ তাদের চেতনার মান সবচেয়ে উন্নত। শ্রমিক-কৃষক জোট বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাবান শ্রেণীকে উৎখাত করবে এবং সমস্ত উৎপাদনশীল সম্পদের  ওপর নিজের হক প্রতিষ্ঠা করবে।  বলা বাহুল্য যে তাদের এই প্রোগ্রাম লেনিনের থিসিস অনুসরণ করে বানানো। এর সঙ্গে  নকশালবাড়ি আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর প্রোগ্রামের তফাৎ আছে। নকশালদের প্রোগ্রাম বলতো যে শ্রমিক না কৃষকই হবে বিপ্লবের অক্ষ। তারা মাও ও লিন বাও থিসিস অনুসরণ করে নিজেদের প্রোগ্রাম বানায় যাতে কৃষকদের মধ্যে গেরিলা বাহিনী তৈরী করে ক্ষমতা দখল করা লক্ষ্য হয়, গ্রামে গ্রামে রেজিমেন্ট তৈরী করে তা দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্র শহরগুলোকে ঘিরে ফেলার কর্মসূচি নেয়, স্লোগান ওঠে "গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো।" তাদের প্রোগ্রাম বলতো যে  ভারতবর্ষের মূল উৎপাদন কৃষিজাত, শিল্প এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল সম্পদ নামমাত্র, তাই কৃষিসম্পদ দখল করতে পারলে, তাতে সামাজিক অধিকার স্থাপন করতে পারলে বিপ্লব সফল। পরে নকশালপন্থী বিভিন্ন দলগুলি এই প্রোগ্রাম থেকে সরে আসে। যেমন সিপিআইএমএল লিবারেশনের এখন যে প্রোগ্রাম তা মোটামুটি সিপিআই সিপিএমের কল্পিত জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের থেকে  খুব একটা ভিন্ন না। মাওবাদীরা যদিও এখনও কৃষক এবং আদিবাসীদের মধ্যে গেরিলা বাহিনী সংগঠিত করার প্রোগ্রাম থেকে সরেনি। এবার উমার খালিদ যা বলেছেন তা সিপিআই, সিপিএম অথবা নকশালদের কল্পিত বিপ্লব থেকে কিন্তু  সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি বলছেন দলিত এবং আদিবাসীরাই বিপ্লবের অক্ষ, তারাই চালিকাশক্তি, কৃষক বা শ্রমিক-কৃষকের যৌথ ফ্রন্ট নয়। আমার মনে হয় এ এক অভিনব ভাবনা। কিন্তু  এই নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। 

আসুন দেখি গুজরাটে উনার আন্দোলনের দিকে। উনার আন্দোলন কিন্তু শুধুই সামাজিক সম্মান এবং ন্যায়ের প্রশ্নে থেমে নেই। দলিতরা প্রতিজ্ঞা করছেন যে তারা আর মরা গরু ছোঁবেন না, ময়লা পরিষ্কার করবেন না, যেসব কাজ তাঁরা হাজার হাজার বছর ধরে করতে বাধ্য হয়েছেন সেই কাজ আর তাঁরা করবেন না। কিন্তু এইখানেই প্রশ্ন চলে আসছে যে তাঁরা যদি এই সাবেকি জীবিকাগুলো থেকে সরে যান তাহলে তাঁরা রোজগার করবেন কি করে? মরা  গরু না ছুঁলে যাঁরা চামার তাঁরা কিভাবে উপার্জন করবেন? যিনি জমাদার তিনি জমাদারী ছেড়ে দিলে রোজগার করবেন কি করে? আর এইখানেই উনার দলিত আন্দোলনের উজ্জ্বল নেতা জিগনেশ মেওয়ানি স্লোগান তুলেছেন "লাঠ লেকে জায়েঙ্গে জমিন খালি কারওয়াযেঙ্গে!" অর্থাৎ  লাঠি নিয়ে নিজেদের হকের জমি ছিনিয়ে নেবো। ভারতবর্ষের অধিকাংশ দলিত, সংখ্যালঘু  এবং আদিবাসীদের হাতে খুব স্বল্প পরিমান উর্বর জমি আছে তাই চাষবাস করে তাদের রোজগার করার উপায় সীমিত, আর এই কারণেই তাঁদের সাবেকি পেশার বাঁধন থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল হচ্ছে। জিগনেশরা তাই দাবি তুলছেন ভূমি সংস্কার এবং ভূমি বন্টনের। একদম সঠিক দাবি কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু ভেবে দেখুন যে সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনও কিন্তু সেই উৎপাদনশীল সম্পদ দখল করার মাধ্যমেই নিষ্পত্তির দিশা পাচ্ছে। অর্থাৎ উৎপাদনশীল সম্পদ দখল করা আর তাতে সামাজিক অধিকার স্থাপন করার সাবেক কমিউনিস্ট পার্টির প্রোগ্রামেই আমরা ফিরে যাচ্ছি, দলিতের দলিত পরিচয়ের চেয়ে তাঁর ভূমিহীন হওয়ার পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 

তাহলে কি করণীয়? কমিনিউস্ট পার্টিগুলির প্রোগ্রামই তাহলে ঠিক? কৃষক অথবা শ্রমিক-কৃষক জোটই বিপ্লবের অক্ষ হবে আর দলিত, আদিবাসী সংখ্যালঘুদের শ্রমিক বা কৃষক পরিচয়টাই মুখ্য হবে, তাঁদের সামাজিক পরিচয়গুলো গৌণ থাকবে? তাই যদি হয় তাহলে ৫০-৬০ বছরেও কেন দলিত আদিবাসী আইডেন্টিটি পলিটিক্স মুছে গিয়ে বামপন্থীদের সঙ্গে মিশে যায়নি? কেন সেই আইডেন্টিটি পলিটিক্স দিন কে দিন শক্তিশালীই হয়ে চলেছে ক্রমশ আর বামপন্থীরা জমি হারাচ্ছে? দলিতদের নিগ্রহ না করলে তো দলিতরা রাস্তায় নেমে জমির দাবিতে মিছিল করতো না তাই না? বর্ণবাদী সংঘ পরিবার দ্বারা নিগ্রহের কারণেই তাঁরা আজ রাস্তায় নেমে জমির দাবি তুলছে, ছত্তিসগড়ের রমন সিংহ সরকার সেনাবাহিনী দিয়ে আদিবাসীদের দমন করেছে বলেই আদিবাসীরা একজোট হয়ে জঙ্গলের অধিকারের দাবি তুলছে। 
তাহলে? আমার মনে হয় উমার যা বলেছেন তা আংশিকভাবে ঠিক। কৃষক-শ্রমিক জোটই বিপ্লবের অক্ষ হতে পারে কিন্তু সেই জোট তৈরী হওয়ার উপকরণ হিসেবে দলিত এবং আদিবাসীদের আইডেন্টিটি ভীষণ রকম প্রয়োজন। মার্ক্সবাদ শ্রমিকের চেতনার ওপর ভরসা করে, যেহেতু তারা সর্বহারা তাই তারাই বিপ্লবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রহরী। কিন্তু ব্যাপক হারে সেই শ্রমিক চেতনা তৈরী হবে কি করে যেখানে আমাদের দেশের জনসংখ্যার মাত্র ১০-১৫% আজকের দিনে  শিল্পের সাথে জড়িত এবং তা দিন কে দিন হ্রাসমান? বরং আমাদের দেশে দু হাজার বছরের বর্ণবাদী শোষণ যে বিপ্লবী চেতনার উপকরণ রেখে গিয়েছে তাকে বামপন্থীরা উপেক্ষা করেছে এতদিন। সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, শ্রমিক কৃষকের একটা বড় অংশ বিপ্লবের পথে চালিত হতে পারে, এবং যে হেতু আমাদের দেশে পুঁজিবাদ ও বর্ণবাদ একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত তাই সামাজিক ন্যায়ের পথে চালিত এই অংশটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবেরও সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রহরী হতে পারে। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি বিষয়টা বিবেচনা করে দেখে কিনা সেটাই এখন দেখবার। 

ফেসবুকে কমেন্ট দিন

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks