আরেকটি ১৫ই আগস্ট, আরেকবার স্বাধীনতা দিবস এলো আর গেলো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে স্বাধীনতার জন্যে যারা লড়েছিলেন, তাদের প্রত্যেকের মাথার মধ্যে হয়তো স্বাধীন ভারতের ধারনা সম্পর্কে আলাদা মতামত ছিলো। ভগত সিং যেই স্বাধীন ভারতের ধারনা মাথায় নিয়ে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছিলেন, আর গান্ধী যে স্বাধীন ভারতের ধারনা বুকে নিয়ে গডসের গুলি খেয়েছিলেন, তার মধ্যে কিঞ্চিত ফারাক রয়েছে।
চট্টগ্রামের পাহাড়ে সূর্য সেনের নেতৃত্বে যেই সুবোধ রায়, অম্বিকা চক্রবর্তী, গনেশ ঘোষ আর লোকনাথ বল একইসাথে কাধে কাধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের তাক করে রাইফেল ছুড়েছেন, স্বাধীন ভারতে তারাই কংগ্রেস আর কমিউনিস্ট - দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়ে একে অপরের বিরোধী হয়ে রাজনীতি করেছে্ন, ভারত নিয়ে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ধারনা কে বাস্তবায়িত করতে।
আমরা, স্বাধীন ভারতের নাগরিক যারা, প্রত্যেকেই হয়তো আমাদের এই দেশের কাঙ্খিত চরিত্র সমন্ধে ভিন্ন ধারনা পোষণ করি। এবং এই ভিন্ন ধারনা কে বাস্তবায়িত করতে হয়তো আমরা অনেকেই নিজেদের স্বল্প পরিসরে কোনরকম ভূমিকা পালন করবার চেষ্টা করি। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে, আমরা যারা ধারনার জগতে একে অপরের বিরোধী, তারাই আবার সহযাত্রীও বটে। কারন স্বাধীনতা তো কোন গন্তব্য নয়, স্বাধীনতা তো যাত্রা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে যারা লড়ে স্বাধীনতা আনলেন, তারা একটা অধ্যায় সমাপ্ত করলেন, এবং স্বাধীনতা যাত্রার পরবর্তী অধ্যায়ের সূচনা করলেন। এই অধ্যায়ের অনেক বৈরিতার মধ্যেও একটা ধারনা অবিচল রয়েছে - বহুত্ববাদ। এই বহুত্ববাদ যতবার আক্রান্ত হয়েছে, এই দেশের মানুষ একজোট হয়ে তাকে রক্ষা করেছে। যাদের ইতিহাসের ভার আমরা বহন করি, তাদের ভারতের ধারনা যে আমাদের মধ্যে প্রবহমান, তাকে আমরা অস্বীকার করি কি করে?
কোন একদিন সুবোধ রায় যখন তেভাগা আন্দোলনের সময় কৃষকদের মিছিলের সামনে হাটছিলেন, তখন কি তার পাশে সূর্য সেন মুচকি হেসে পায়ে পা মেলান নি?
গুরগাঁও তে মারুতি কারখানার যে শ্রমিকরা স্ট্রাইক করে কয়েক বছর জেল খেটে এলেন, তাদের সাথে জেলের ভেতর কি ভগত সিং আর বটুকেশ্বর দত্ত বসে ১৯২৯ এ ট্রেড ডিসপুট এক্ট পাশ করবার দিন এসেম্বলিতে বোম মারবার গল্প শোনায়েনি?
এই ১৫ই আগস্ট গুজরাটে আহমেদাবাদ থেকে উনা অবধি দলিতদের মহামিছিলের শেষে জিগ্নেশ মেওয়ানি স্টেজে উঠে যখন দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষনা করলেন - 'তুমহারা মাতা তুম রাখো, হামে আপনি জমিন দো', তখন কি আকাশে ছোড়া হাজারটা মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের মধ্যে একটা হাত আম্বেদকরের ছিলো না?
বস্তারে শোনি সোরি যখন কর্পোরেট মাফিয়ার হাতে আদিবাসীদের জল-জমি লুঠের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কোন এক থানায় পুলিশের হাতে অত্যাচারিত হয়ে এক কোনে পড়েছিলেন, তখন কি ইলা মিত্রর কোলে মাথা রেখে কিছুক্ষন জিরিয়ে নেননি? এই ১৫ই আগস্ট যখন শোনি সোরি বস্তারের গ্রামগুলোর মধ্যে দিয়ে আদিবাসীদের মহামিছিলে হেটে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন, তখন কি তার পাশে হাত ধরে প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার হাটছিলেন না?
স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের বর্তমান অধ্যায়ে এই বলিষ্ঠ চরিত্রগুলো যখন দেশ জুড়ে তাদের ভারতের ধারনা কে বাস্তব করে তুলতে মাঠে নেমেছে, 'আজাদি'র যাত্রায় সহযাত্রী হয়েছে, তখন আমরা সহনাগরিক হিসেবে স্বাধীনতার এই যাত্রা কে মহাড়ম্বরে উদযাপন করবো না কেন? আমরা প্রত্যকেই তো লড়ছি এই আজাদির জন্যে - আমাদের ভারতের ধারনা কে রক্ষা করবার জন্যে। ভুলে গেলে চলবে কি করে, আজ লাল কেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতা দিয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রী, তিনি এমন একটি সংগঠনের সদস্য যারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে শুধু খাতায়-কলমে বিরোধিতাই করে থামেননি, মাঠে নেমে তার বিরুদ্ধে লড়েছেন, যারা এই দেশের পতাকা, সংবিধান কোনটাকেই স্বীকৃতি দেননি।
আজাদির যাত্রা থামবে কেন?